মুরগীর খামারে ডিম উৎপাদন তথা লেয়ার পালন দীর্ঘদিন ধরে চলেছে। বাণিজ্যিক কিছু খামার ব্যতিত গ্রামে গঞ্জে স্থাপিত খামারগুলি তেমন লাভজনকভাবে পরিচালিত হতে পারছে না মূলতঃ খামার পরিকল্পনায় ও ব্যবস্থাপনায় বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাব ও চলমান প্রক্রিয়ায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি ফ্যাক্টরের কারণে। খামারে বহিঃপরজীবীর আর্বিভাব ও নিয়ন্ত্রণ উত্ত ক্ষুদ্র কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।
যে সব পরজীবী পোষকের দেহের বাইরের অংশ আক্রান্ত করে তাদেরকে বহিঃপরজীবী বলে। এসব পরজীবী আর্থোপোডা গোএভুত্ত। আর্থোস অর্থ সন্ধি (Joint) এবং পডোস অর্থ পা অর্থাৎ বহিঃপরজীবীরা সন্ধিপদী। আমাদের মত গরম ও ভেজা আবহাওয়ায় হাঁস-মুরগীর গায়ে অনেক সময়ই বিভিন্ন প্রকার পরজীবী জন্মাতে দেখা যায়। এ গুলির মধ্যে বিভিন্ন প্রকার উকুন (Lice), আঠালী (Ticks) ও মাইটস (Mites) প্রধান। ব্রয়লার জাতের জীবনকাল সংক্ষিপ্ত (৪-৬ সপ্তাহ) হওয়ায় এ ধরনের তেমন কোন সমস্যা না হলে ও লেয়ার ও ব্রিডার জাতে অনেক সময়ই এ সব পরজীবী বিশেষ ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে।
বহিঃপরজীবী মুরগির নি¤œলিখিতভাবে ক্ষতি করে:
ক) মৃত্যু ঃ বহিঃপরজীবীর আক্রমণে সাধারনত পোষকের মৃত্যু ঘটে না তবে এদের দ্বারা বাহিত রোগ মুরগির মৃত্যু ঘটায়।
খ) রত্তশূন্যতা ঃ রত্তচোষা বহিঃপরজীবীর তীব্র আক্রমণের কারণে পোষকের দেহের প্রচুর রত্ত শোষণের ফলে রত্তশূন্যতা দেখা দেয়; যার ফলে মুরগির সার্বিক উৎকর্ষতা দারুনভাবে ব্যাহত হয়। মাংস ও ডিম উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
গ) সংক্রামক রোগের সংক্রমণ ঃ ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস আক্রান্ত মুরগি থেকে বহিঃপরজীবী সুস্থ মুরগিতে রোগের বিস্তার ঘটায়।
ঘ) বিরত্তি ও উত্তেজনা ঃ প্রায় সব বহিঃপরজীবী পোষকে কম বেশি উত্তেজনা ও বিরত্তি সৃষ্টি করে। যেসব পরজীবী বিশেষ করে উকুন ত্বকের মরামাস খায় সেগুলো ত্বকের উপর চলাফেরার সময় অত্যন্ত বিরত্তি সৃষ্টি করে। মেঞ্জ মাইটস এর আক্রমণে ত্বকে তীব্র প্রদাহ ও ক্ষত সৃষ্টি হয়। এর ফলে মুরগির পালক খসে পড়ে এবং দৈহিক বৃদ্বি ও ডিম উৎপাদন হ্রাস পায়।
উকুন (Lice) ঃ উকুন ডানাবিহীন এক প্রকারের কীট। এরা দংশন বা শোষণ করার ক্ষমতাসম্পন্ন তাই এদেরকে দংশনকারী ও শোষক উকুন বলা হয়। এদের তিন জোড়া পা। এদের পা ছোট ও শত্ত হওয়ায় পোষকের পালক, চুল ও ত্বকে চলাচল ও দৃঢ়ভাবে লেগে থাকার উপযোগী। প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত বয়সের উকুন দেখতে একই রকম।

দু ধরনের উকুন দেখা যায়- ১) দংশনকারী বা কামড়ানি উকুন ২) শোষক বা রত্তচোষা উকুন।
রত্তচোষা উকুন শুধুমাএ স্তন্যপায়ী প্রাণীকে আক্রমণ করে পক্ষান্তরে দংশনকারী উকুন মুরগী ও স্তন্যপায়ী উভয়কে আক্রমণ করে।
সাধারণতঃ বুক, পেট ও পাখার নীচে এ সমস্ত উকুন অধিক পরিমাণে বাস করে। কামড়ানি উকুনগুলি চামড়ার উপরের অংশে কামড়ায় ফলে চুরকানি হয়। আর রত্তচোষা বা শোষক উকুন কামড়ায় ও রত্ত ও শোষে। উকুনের ব্যাপক আক্রমণের ফলে আক্রান্ত মুরগির চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। ডিম পাড়া মুরগির ডিম উৎপাদন কমে যায়। রত্ত চোষা উকুনের ফলে মুরগির রত্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
পৃথিবীর যে দেশেই মুরগি প্রতিপালিত হয়, সেখানেই কম বেশি উকুন পাওয়া যায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে খামারে পালিত মুরগির শরীরে ও মাঝে মাঝে বিভিন্ন প্রকার উকুন হতে দেখা যায়। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় শরৎ এবং শীতকালে উকুনের প্রাদুর্ভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়। অস্বাস্থ্যকর ও অবহেলিত পরিবেশে প্রতিপালিত মুরগির দেহে উকুন দ্বারা রোগ বেশী হয়ে থাকে। সব বয়সের মুরগিই উকুন রোগে আক্রান্ত হয়। বয়সের সাথে এ রোগের বিশেষ সর্ম্পক নেই।
মুরগিতে পাওয়া যায় এ ধরনের কয়েকটি উকুন হল :
১) কিউক্লোটোগেসটার হেটারোগ্রাফা: এটা মাথায় পাওয়া যায়
২) গোনিয়োকোটিজ গেলিনি: এটা পালকের মধ্যে বাস করে।
আঠালী (Ticks) ঃ মুরগি ও অন্যান্য পাখিতে যে সমস্ত আঠালী পাওয়া যায় সেগুলো আরগাস পারসিকাস গস্খুপের অর্ন্তগত এবং এরা হচ্ছে:
১) আরগাস পারসিকাস
২) আরগাস রেডিয়েটাস
৩) আরগাস মিনিয়েটাস
আঠালী হাঁস-মুরগির রত্ত শোষণ করে এবং এদের লালাগ্রস্খি থেকে বিষাত্ত রস নিঃসৃত হয় যা হাঁস-মুরগির চামড়া ও পালকের ক্ষতি করে। আঠালি আক্রান্ত হলে শরীর চুলকায়, ডিম পাড়া কমিয়ে দেয়, দৈহিক বৃদ্বি ব্যাহত হয় এবং রত্তশূন্যতা দেখা দেয়। অনেক সময় আঠালী হাঁস-মুরগিতে স্পাইরোকেইটস রোগ ছড়িয়ে থাকে।
মাইটস (Mites) ঃ মাইট একারিনা অর্ডারের অর্ন্তগত এক প্রকার ক্ষুদ্র কীট। এদের দেহ এক খন্ডে বিভত্ত এবং চার ঝোড়া পা আছে। প্রাকৃতিক নিয়মে বিভিন্ন প্রকারের মাইট মুরগি এবং অন্যান্য পাখির দেহ আক্রান্ত করে। এদের মধ্যে কতকগুলো রত্তপান করে, কতক ত্বক ছিদ্র করে তার মধ্যে বাস করে, কতকগুলো পালকে বাস করে এবং আরো কয়েক প্রকার দেহ অভ্যন্তরের বিভিন্ন অঙ্গ আক্রান্ত করে।

মুরগিতে কয়েক প্রকার মাইটস হতে পারে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মুরগির রেড মাইট, স্কেলি লেগ মাইট, ডিপ্লোমিং মাইট ইত্যাদি।
রেড মাইটস মুরগীতে সচরাচর বেশী দেখা যায়। এরা সাধারণত গরমকালে বেশী সক্রিয় হয়ে উঠে। এরা দিনের বেলায় মুরগির ঘরের দেওয়াল, মেঝে ইত্যাদির ফাটলে লুকিয়ে থাকে। তবে রাএিকালে মুরগির শরীরে আসে এবং রত্ত শুষে খায়। যে সমস্ত মুরগি কুঠরী বা ছোট ঘরে রাএে থাকে, সাধারণত সেসব মুরগিকেই অধিক আক্রান্ত করে।
স্কেলি লেগ মাইট অত্যন্ত ছোট আকারের। সাধারণ মাইট যেখানে ১ ইঞ্চির ২৫ ভাগের ১ ভাগ, সেখানে স্কেলি লেগ মাইট ১ ইঞ্চির ১০০ ভাগের ১ ভাগ হয়ে থাকে। এটি মেঝে থেকে সংক্রমিত হয় বলে সন্দেহ করা হয়। এরা মুরগির পা, লতি ইত্যাদি জায়গায় যেখানে পালক নেই সেখানে চুলকানির মত ময়লাযুত্ত ঘা এর সৃষ্টি করে এবং পা মোটা হয়ে যায়। ফলে তীব্র প্রকৃতির রোগে মুরগি খোড়ায়। এছাড়া পায়ের স্বাভাবিক আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়।
ডিপ্লোমিং মাইট পালকের গোড়ার নিকট চামড়া ছিদ্র করে পালকের মধ্যে প্রবেশ করে, জ্বালাপোড়া ও চুলকানির সৃষ্টি করে। আক্রান্ত মুরগি চুলকাতে চুলকাতে সেখানের পালক নষ্ট করে ও তুলে ফেলে এবং এর ফলে বড় আকারের ক্ষতের সৃষ্টি হয়। যে কোন ধরনের মাইটস হলে মুরগির স্বাস্থ্যের ক্ষতিসহ ডিমপাড়া হ্রাস পায়। এছাড়া আক্রান্ত মুরগি যেখানে সেখানে শুয়ে শরীর ঘষে চুলকাতে শুরু করে।
চিকিৎসা ঃ নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয় কথাটি বহিঃপরজীবীর ক্ষেএে বেশী প্রযোজ্য। অধিকাংশ পরজীবীকে ভাল ব্যবস্থাপনা যেমন ভাল স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থ্াপনা (Sanitation), উপযুত্ত ঘর এবং পর্যাপ্ত পুষ্টির নিশ্চিত করার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। গৃহপালিত মুরগির ক্ষেএে প্রতি মাসে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বিকেল বেলা গৃহে প্রবেশের পূর্বে করলে উত্তম। নিম্নে মুরগীর বহিঃপরজীবী চিকিৎসা পদ্বতি ছক আকারে দেওয়া হল:
পেস্টিসাইড | যার উপর কার্যকর | ব্যবহার | প্রকৃতি |
ক্যাম্ফর | স্কেলি লেগ মাইট | মুরগির পা ও পায়ের পাতা | অয়েন্টমেন্ট |
ডায়াটোমেসিয়াস আর্থ (DE) | উকুন, নর্দান ফাউল মাইট, রুস্ট মাইট | মুরগি, বালুগোসল (dust bath) | পাউডার |
রসুনের রস | নর্দান ফাউল মাইট | মুরগি | স্প্রে |
আইভারমেকটিন | উকুন, নর্দান ফাউল মাইট, রুস্ট মাইট, স্কেলি লেগ মাইট | মুরগি | মুখে বা ইনজেকশন |
নিম তৈল | উকুন, নর্দান ফাউল মাইট, রুস্ট মাইট | মুরগি | স্প্রে |
পেট্রোলিয়াম জেলি/ সালফার যুত্ত | স্কেলি লেগ মাইট | মুরগির পা ও পায়ের পাতা | অয়েন্টমেন্ট |
পাইরেথ্রিন ও পারমেথ্রিন | উকুন, নর্দান ফাউল মাইট, রুস্ট মাইট | মুরগি | পাউডার ,স্প্রে বা চুবানো |
সালফার | উকুন, নর্দান ফাউল মাইট, রুস্ট মাইট | মুরগি | পাউডার ,স্প্রে |
তবে কীটনাশক ও ডিসইনফ্যাকটেন্ট একসাথে ব্যবহার করা যাবে না কারণ একে অপরের টক্সিক উপাদান ধ্বংস করবে। ফলে প্রত্যেকের কার্যক্ষমতা হ্রাস পাবে।
thank you.