আমাদের দেশে আবহাওয়াজনিত কারণে পোল্ট্রিতে আন্ত্রিক পরজীবীর সংক্রমণ প্রায়শ ঘটে থাকে। তিন ধরনের আন্ত্রিক পরজীবী এ জন্য মূলত দায়ী। এগুলো হচ্ছে:
১) গোলকৃমি (Nematodes/ Roundworms)
২) ফিতাকৃমি (Cestodes/Tapeworms) এবং
৩) পাতাকৃমি (Trematodes/Flukes)
তবে উন্নতমানের ব্যবস্থাপনা, অল্প সময়ে পালিত মুরগী বিশেষত ব্রয়লার পালন, খাঁচায় মুরগি পালন, স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা ইত্যাদি কারণে হাঁস-মুরগির ভিতরের পরজীবী বা কৃমি দ্বারা ক্ষতির সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে গেছে। তবু ও অনেক সময় বিশেষভাবে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গৃহপালিত মোরগ-মুরগীতে এবং ডিপ লিটারে পালিত ডিম পাড়া ও ব্রীডারের কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
যে সমস্ত উপায়ে পরজীবী ক্ষতি করে থাকে: কৃমিতে আক্রান্ত হলে যে সব ক্ষতি হতে পারে সেগুলো হচ্ছে:
১) প্রতিটি কৃমিরই একটি নির্দিষ্ট আবাসস্থল রয়েছে যেখানে সে ক্ষত সৃষ্টি করে, ফলে মোরগ মুরগীর স্বাভাবিক ক্রিয়ার ব্যাঘাত ঘটে এবং মোরগ মুরগী ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
২) কিছু কৃমিরয়েছে যেগুলো বিভিন্ন রোগ জীবাণু বহন করে এবং রোগ সৃষ্টিতে সহায়তা করে।
৩) অন্ত্রে যদি অধিক সংখ্যক কৃমির উপস্থিতি ঘটে তাহলে খাদ্য চলাচল ব্যাহত হয় এবং আক্রান্ত মোরগ মুরগী মারা যেতে পারে।
৪) কৃমি মোরগ মুরগীর খাদ্য থেকেই পুষ্টি গ্রহণ করে ফলে মোরগ মুরগী অপুষ্টিতে ভোগে।
৫) পরজীবী কিছু টক্সিন ছড়াতে পারে যা হাঁস মুরগির ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে।
৬) মুরগি কৃমি দ্বারা আক্রন্ত হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং যে কোন রোগ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।
৭) কৃমির জন্য মোরগ মুরগির মৃত্যুহার (Mortality) সাধারণত কম হয় কিন্তু উৎপাদনে মারাত্নক ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
৮) কৃমির আক্রমণে বাড়ন্ত পাখির বৃদ্বি ব্যাহত হয় এবং অবশেষে কৃশকায় (Emaciated) হয়ে মারা যায়।
চিএ: মুরগীর মলে দৃশ্যমান কৃমি
মুরগির গোল বড় কৃমি: এই কৃমি দেখতে কেঁচোর মত হয় বলে এদেরকে কেঁচো কৃমি বলা হয়। এরা মুরগির ক্ষুদ্রান্তে বাস করে। এই কৃমি মুরগি ছাড়া ও গিনি ফাউল, র্টাকি, রাজহাঁস ও বন্য প্রাণিকে আক্রান্ত করে থাকে। কেঁচো ও ফড়িং এদের ডিম খেয়ে এ রোগ বিস্তারে সাহায্য করে। পূর্ণবয়স্ক মুরগির চেয়ে ছোট বাচ্চারা এ রোগে বেশি সংবেদনশীল হয়। গোল কৃমি লম্বায় ২-৫ ইঞ্চি হয়ে থাকে। বড় কৃমিরা খাদ্য নালীতে ডিম পাড়ে যা বিষ্ঠার সাথে বের হয়ে আসে এবং তা আবার খাদ্য বা পানির মাধ্যমে সুস্থ মুরগির দেহে প্রবেশ করে তাদেরকে আক্রান্ত করে।
চিএ: মুরগীর গোলকৃমি (এসকারিডিয়া গেলি)
লক্ষণ: দৈহিক বৃদ্বি ঠিকমত হবে না। আক্রান্ত মুরগিগুলি ঝিমাবে। পালক উসকো খুসকো হবে। পাতলা পায়খানা থাকবে। ডিম পাড়া কমিয়ে দেবে।
চিকিৎসা: নিম্নোত্ত যে কোন একটি কৃমিনাশক ওষুধ আক্রান্ত মুরগিকে খাদ্য বা পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।এরপর ২১ দিন পর পুনরায় একই নিয়মে এ ওষুধ প্রদান করতে হবে।
১) এলবেন্ডাজল: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০-৪৫ মিগ্রা খাদ্য বা পানির সাথে প্রদান করতে হবে।
২) ফেনবেন্ডাজল: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৬.২৫-১৬ মিগ্রা খাদ্যের সাথে মিশিয়ে প্রদান করতে হবে।
৩) লিভামিজল: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১৮-৩৬ মিগ্রা খাবার পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
৪) মেবেন্ডাজল: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৫০ মিগ্রা খাদ্যবা পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
৫) পাইপারাজিন এডিপেট: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ০.৫-১ গ্রাম ।
৬) পাইপারাজিন হেক্সাহাইড্রেট: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ০.৫ গ্রাম (লার্ভার বিরুদ্বে কাজ করে না) তবে ১.২ গ্রাম/কেজি দৈহিক ওজন হিসাবে ১০-৩০ দিন বয়সী কৃমির বিরুদ্বে কার্যকর।
৭) টেট্রামিজল হাইড্রোক্লোরাইড: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৪০-৬০ মিগ্রা সব বয়সের কৃমির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
রোগ প্রতিরোধ: খামারের পরিবেশ সবসময় স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে হবে। বন্য পাখিসহ পূর্ণবয়স্ক মুরগির সাথে বাড়ন্ত মুরগির সংর্স্পশ রোধ করতে হবে। কেঁচো এ রোগ ছড়ায়। এজন্য মুরগি যেন কেঁচো না খায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
বৃহদন্তের কৃমি হেটারকিস গেলিনেরাম: এ ধরনের কৃমি সাধারণতঃ খাদ্যনালীর সিকামে থাকে যা ১ থেকে ১.৫ সেমি পর্যন্ত লম্বা, সাদা রং এর সুতার মত দেখতে। পায়খানার সাথে এদের ডিম আসে এবং সেখান হতে বাচ্চা, যা আবার সুস্থ মুরগি খায় এবং আক্রান্ত হয়।
হেটারাকিসের কয়েকটি প্রজাতি আছে। এগুলো হচ্ছে: ক) হে. বেরামপোরিয়া খ) হে. গ্যালিনেরাম গ) হে. প্যারিসি
লক্ষণ: মুরগি ঝিমাতে থাকে। ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়। ডিম পাড়া কমিয়ে দেয়। বাদামী রং এর ডায়রিয়া দেখা যায়। মুরগির শরীর শুকিয়ে যায়। পরিশেষে আক্রান্ত মুরগির মৃত্যু ঘটে।
চিকিৎসা:নিম্নোত্ত যে কোন একটি ওষুধখাদ্য বা পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে:
ক) লিভামিসল হাইড্রোক্লোরাইড: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৩০-৪০ মিগ্রা প্রদান করতে হবে।
খ) টেট্রামিসল হাইড্রোক্লোরাইড: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৪০ মিগ্রা প্রদান করতে হবে।
গ) ফেনবেন্ডাজল: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০-১৬ মিগ্রা প্রদান করতে হবে।
ঘ) ফেনোথায়াজিন: একটি পূর্ণ বয়স্ক মুরগিকে ১ গ্রাম প্রদান করতে হবে।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা: খামারে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। খাদ্য ও পানি যেন বিষ্ঠা দ্বারা দূষিত না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রুটিন অনুযায়ী কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে।
ক্যাপিলারিয়া: এই রোগ ক্যাপিলারিয়া গণভুত্ত বিভিন্ন প্রজাতি দ্বারা সৃষ্ট হয়ে থাকে।এই কৃমি দেখতে চুল বা সুতার তাই এদেরকে সুতাকৃমি বা চুল কৃমি বলে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে এ রোগ হয়ে থাকে। এ ধরনের কৃমি মুরগির খাদ্যনালীর উপরের অংশে বিশেষ করে ইসোফেগাস এবং ক্রপ অংশে থাকে। এটি লম্বায় ১ হতে ৬ সেমি পর্যন্ত হতে পারে। এদের ডিম পায়খানার সাথে আসে এবং সুস্থ মুরগির খাদ্যের সাথে পেটের ভিতরে যায় এবং সেখানে প্রাপ্ত বয়স্ক কৃমিতে রুপান্তরিত হয়। মুরগি ছাড়া ও হাঁস,কবুতর, টারকি ও অন্যান্য বন্য পাখিতে ও এ রোগ হয়। কেঁচো মাধ্যমিক পোষক হিসাবে এ রোগের সংক্রমণ ঘটায়। মোরগ মুরগী দূষিত খাদ্য বা পানি অথবা মাধ্যমিক পোষক ভক্ষণ করে আক্রান্ত হয়ে থাকে।
লক্ষণ: অল্প সংখ্যক কৃমির আক্রমণে তেমন কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না। অধিক সংখ্যক কৃমির সংক্রমণে বর্ধনশীল মুরগির দৈহিক বৃদ্বি ব্যাহত হয়। ডিম পাড়া মুরগির ডিম উৎপাদন হ্রাস পায় । তাছাড়া এসব ডিমের উর্বরতা শত্তি ও কম হয়। পালক এলোমেলো থাকে। পাতলা পায়খানা হবে। ওজন হ্রাস পায় এবং ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মুরগির স্বাভাবিক পানি পান হ্রাস পায়। রত্তশূন্যতা দেখা দেয়। আক্রান্ত মুরগি ক্রমশ শুকিয়ে যায় এবং পরিশেষে মৃত্যু ঘটে থাকে।
চিকিৎসা: নিম্নোত্ত যেকোন একটি কৃমিনাশক ওষুধ খাদ্য বা পানির সাথে মিশিয়ে প্রদান করতে হবে।
১) লিভামিজল ফসফেট/হাইড্রোক্লোরাইড: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০-৪৮ মিগ্রা প্রদান করতে হবে।
২) ফেনবেন্ডাজল: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৫-৬.২৫ মিগ্রা অথবা ৬ গ্রাম ২৫% WP ১৫ কেজি খাদ্যের সাথে মিশিয়ে পরপর ৪ দিন খাওয়াতে হবে।
৩) মেথিরিডিন: প্রতি ১০০ মিলি খাবার পানিতে ২০০-৪৫০ মিগ্রা মিশিয়ে মুরগির ঝাঁকে ২৪ ঘন্টার জন্য পান করতে দিতে হবে।
রোগ প্রতিরোধ: খামারে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। খাবার পানি বা খাদ্য বিষ্ঠার সংর্স্পশে যেন না আসে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মাধ্যমিক পোষক কেঁচোর সংখ্যা হ্রাস করতে হবে। ঝাঁকে নতুন মুরগি প্রবেশ করানোর আগে কৃমিনাশক ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে।
ফিতা কৃমি: বেশ কয়েক ধরনের ফিতা কৃমি মুরগিকে আক্রান্ত করে থাকে। এদের কোনটা ১ মিমি থেকে ও ছোট আবার কোনটা ২৫ সেমি এর মত লম্বা হতে পারে। এসব কৃমি খাদ্যনালীর মাঝে থাকে। কৃমির ডিম বিষ্ঠার সাথে বাইরে আসে এবং শামুক, ঝিনুক, মাছি বা পিঁপড়া ইত্যাদি যেখানে যেটা প্রযোজ্য তার ভিতর প্রবেশ করে। হাঁস মুরগি যখন এসব বাহক প্রাণী খায় তখন এরা নতুনভাবে এ রোগে আক্রান্ত হয়।
লক্ষণ: রোগের তীব্রতা ফিতাকৃমির প্রজাতি ও মুরগির বয়সের উপর নির্ভরশীল। সাধারণত মুরগির বাচ্চা এই কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। আক্রান্ত মুরগির খাদ্য গ্রহণে অনীহা দেখা দেয় ও পানি র পিপাসা বৃদ্বি পায়। ফিতা কৃমির সংক্রমণের ফলে রত্তশূন্যতা দেখা দেয় ও মুরগি কৃশকায় হয়ে পড়ে। সংক্রমণ মারাত্নক হলে অল্প বয়সী মুরগি মৃত্যু হয়। ডিমপাড়া মুরগীর ডিম উৎপাদন হ্রাস পায়। পালক উসকো খুসকো থাকে। পাতলা পায়খানা হয়।
চিকিৎসা: ফিতা কৃমির চিকিৎসার জন্য নিম্নলিখিত ওষুধের যে কোন একটি ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে:
১) ডাইক্লোরোফেন: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১.২ গ্রাম। ১৫ দিন পর দ্বিতীয় মাএা প্রয়োগ করতে হবে।
২) ফেনবেন্ডাজল: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৫ গ্রাম হিসাবে খাদ্যের সাথে দিনে একবার।
৩) অক্সফেন্ডাজল: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১১০ মিগ্রা।
৪) রেসোরান্টেল: প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১ মিলি।
রোগ প্রতিরোধ: ফিতা কৃমির সংক্রমণে মাধ্যমিক পোষকের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং রোগ প্রতিরোধের জন্য মাধ্যমিক পোষকের উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরী। এজন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া উচিত তা হল:
১) কীটনাশক পদার্থ যেমন ক্লোরডোন বা প্যারাথিওন স্প্রে করে মাধ্যমিক পোষক যেমন মাছি, ফড়িং, গুবরে পোকা ইত্যাদি নিধন করতে হবে।
২) শামুক নির্মূলের জন্য কপার সালফেট ১ঃ১০০,০০০ অনুপাতে স্প্রে করলে ৮ ঘন্টার মধ্যে শামুক মারা যাবে।
৩) খামারে নিয়মিতভাবে ফিতাকৃমিনাশক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে।
রেফারেন্স: ১) পোল্ট্রি রোগ ব্যাধি, এডভান্স এনিমেল সাইন্স ২) ইন্টারনেট
ভাল লেগেছে