ইনফেকশাস ল্যারিংগোট্রাকিয়াইটিসঃ
বাংলাদেশে এই রোগটির উপস্থিতি নিয়ে পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে চলছে বিতর্ক। তাই আজকে এই বিতর্ক দূর করতে কিছু লেখার চেষ্টা করছি। ইনফেকশাস ল্যারিংগোট্রাকিয়াইটিস রোগটি হলো হারপিস ভিরাইডি (Herpesviridae) পরিবারের ইলটু (ilto) ভাইরাস গোত্রের একটি ভাইরাস। এটি মোরগ মুরগির শ্বাস তন্ত্রের উপরিভাগের একটি রোগ যাহা ল্যারিংক্স ও ট্রাকিয়াতে সীমাবদ্ধ।
এই রোগটি সকল বয়সের মুরগির হয়ে থাকে তবে ৪ সপ্তাহ বয়সের আগে সাধারনত হয় না। চোখের চারপাশে ফুলে যাওয়া, চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া, নাক দিয়ে কফযুক্ত পানি ঝরা, গলা লম্বা করে শ্বাস নেওয়া, মাঝে মাঝে রক্তভমি হওয়া, শ্বাস নিতে গড় গড় শব্দ হওয়া ও চোখের কোণে হলদে ধরনের প্লাগ জমা হলো এ রোগের প্রধান লক্ষন সমূহ। পোস্ট মোর্টেম লক্ষন হলো ট্রাকিয়াতে রক্তক্ষরন হওয়া ও শ্বাস তন্ত্রের মুখে ক্যাজিয়াস প্লাগ পাওয়া। মৃত্যুহার ১-২০% পর্যন্ত হয়ে থাকে তবে ক্ষেত্র বিশেষে ৫০% ও ছাড়াতে পারে। সারাবছরব্যাপি হতে পারে তবে শীতকালে এর প্রকোপ বেশী। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সারাজীবন ধরে রোগটি চলতে থাকে, বিরক্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি করে, উৎপাদন কমে যায় ও কালের পরিমান বেড়ে যায়। ফলে ক্ষতির পরিমান অনেক বেশী হয়ে থাকে।
এই রোগটি পৃথিবীর শীতপ্রধান দেশে হরহামেশায় হয়ে থাকে। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এ রোগটির প্রকোপ বেড়েছে। চায়না, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ সহ অনেক দেশ এখন এ সমস্যায় ভোগছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশে এই রোগটির উপস্থিতি নিয়ে। আমরা যারা বেসরকারী পর্যায়ে মাঠে আছি, আমি সহ তারা সকলেই এই রোগটির বিষয়ে একমত, যে, এটি বাংলাদেশে বর্তমান। কিন্তু বেশকিছু সরকারী প্রাণিচিকিৎসক এটি মানতে নারাজ। তাই তাদের উদ্যেশ্যে এই রোগটি কিভাবে বাংলাদেশে এল তার বিস্তারিত ইতিহাস তুলে ধরবো।
আমাদের দেশে ২০০৬ সালের আগে এই রোগটির কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ২০০৬-২০০৭ সালে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি হ্যাচারীর লেয়ার বাচ্চাতে এই রোগের লক্ষন গুলো প্রকাশ পেতে থাকল। তখন আমি আমার সার্ভিসের কারনেই সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় ৫৪ টি জেলায় যেখানে লেয়ার ফার্ম বেশী সেখানে প্রতি নিয়ত পরিদর্শন করেছি। তখন এই সকল লক্ষন গুলোকে আমরা কেউ কেউ করাইজা ভেবে, কেউ কেউ মাইকোপ্লাজমা ভেবে চিকিৎসা দিয়েছি কিন্তু কোন ফলাফল পায়নি। ২০০৭ সালে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা দেখা দেওয়ার পর এটিকে অনেকেই বার্ড ফ্লু মনে করে অনেক খামারী মুরগি বিক্রয় করে দিয়েছেন। তখন থেকেই আমার মনে একটা আগ্রহ জাগল এই রোগটি নিয়ে গবেষনা করার। প্রথমেই আমি এই রোগের লক্ষন গুলোর সাথে প্রায় কাছাকাছি রোগ যেমন করাইজা, মাইকোপ্লাজমা, ব্রংকাইটিস, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি রোগের লক্ষন গুলোকে বিভিন্ন ভাবে মিলাতে চেষ্টা করে দেখলাম যে না এটা একেবারেই আলাদা একটা রোগ এবং এটি ল্যারিংগোট্রাকিয়াইটিসের সাথেই মিলে যায়। তখন আমি ভাবতে লাগলাম কিভাবে এই রোগটি আমাদের দেশে আসতে পারে? এটি খোজ করতে গিয়ে দেখলাম বেশ কিছু ব্রীডার ফার্ম ও বানিজ্যিক খামার এই রোগের লাইভ ভ্যাকসিন দিচ্ছেন এবং তারা সফলও হয়েছেন।
এই ভ্যাকসিনের ইতিহাস নিতে গিয়ে দেখলাম ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম এই রোগের লাইভ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয় একটি স্বনামধন্য জিপি ফার্মে (অধুনা বিলুপ্ত)। ফার্মটি ছিল এ্যাকুয়া ব্রীডারস লিঃ, মাঝিপাড়া, তেতুলিয়া, পঞ্চগড়। আমার নিজের সৌভাগ্য হয়েছিল, ২০০৬ সালের মে হইতে নভেম্বর পর্যন্ত ঐ প্রতিষ্ঠানের একটা জিপি ফ্লক লালন পালন করার দায়ীত্ব পালন করা। তখন জিপি মানেই বিশাল একটা ব্যাপার মনে হতো আমাদের কাছে। জিপি ফার্মের সকল কিছু পরিচালিত হতো বেশ কিছু বিদেশী কনসালটেন্ট দ্বারা। তারা যা বলতো আমরা না বুঝেই তাই করতাম। ঐ সময় আমি জিপি ফার্মের ভ্যাকসিনেশন সিডিউল এ দেখি এই রোগের লাইভ ভ্যাকসিন। আমি সাথে সাথে ডাঃ নাজমুল হাসান সিদ্দিকি (ঐ সময়ের ঐ প্রতিষ্ঠানের টেকনিক্যাল ম্যানেজার, বর্তমানে বাকৃবির এনাটমি ও হিস্টোলজিতে সহযোগী প্রফেসর) সাহেবকে এই রোগটি আমাদের দেশে নাই জানালে উনি বলেন, এটা জিপি ফ্লক, তাই এ ভ্যাকসিন বিদেশীরাই করার জন্য পরামর্শ দিয়েছে। আমি তখন ভালভাবে ব্যাপারটি বুঝাতে পারিনি। এমনিভাবে কাজি, প্যারাগন, এম এম আগা, আফতাব সহ যাদের জিপি আছে প্রত্যেকেই এই ভ্যাকসিনটি ব্যবহার করেন। পরবর্তিতে ২০০৮-২০০৯ এ যখন দেখলাম এই রোগটি বানিজ্যিকভাবে পালিত লেয়ার মুরগিতে ব্যাপকভাবে পাওয়া যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ সরকার এই ভ্যাকসিন আমদানি করা বন্ধ করে দিল। আমাদের প্রাণি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা ২০০৪ সালে কোন প্রকার সার্ভে ছাড়াই কেবল মাত্র বিদেশীদের পরামর্শে এই লাইভ ভ্যাকসিনটি জিপি ফার্মে করার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে আনা হলো। এভাবেই এই রোগের জীবানু বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। যার ফলে এই রোগটি যখন সারাদেশে বিস্তার লাভ করলো তখন এই ভাইরাস বাংলাদেশে নাই নাই বলে বানিজ্যকভাবে ভ্যাকসিন আমদানি বন্ধ করে দিলো। ফলে আমাদের হাজার হাজার আক্রান্ত প্যারেন্ট ও লেয়ার মুরগি থেকে রোগটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। এ যেন খাল কেটে কুমির এনে খালের পানিতে মাংস দেওয়ার সামিল। পাশাপাশি আমাদের শ্রদ্ধাভাজন কিছু বিশেষজ্ঞ যারা বয়ান দিয়ে চলেছেন, এই রোগটি নাকি বাংলাদেশে নাই। তাই এ বিতর্ক দূর করতে আমি গবেষনার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। তাই ২০১০ সালে আমি বাকৃবির মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগে এই বিষয়ে প্রফেসর শহিদুর রহমান খান (বর্তমানে এল আর আই এ গবেষক হিসেবে কর্মরত) এর তত্ত্বাবধানে এমএস করার জন্য ডাঃ মোঃ শফিকুল ইসলামকে (বর্তমানে অত্র বিভাগে প্রভাষক) গাজিপুর জেলার বিভিন্ন ফার্মের আক্রান্ত মুরগি পাঠিয়ে সহায়তা করি। যে কয়টি নমুনা পাঠিয়েছিলাম তার প্রায় সবকটিই পজিটিভ ছিল। ২০১০ সালে তার এই থিসিস বাংলাদেশ ভেটেরিনারি মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে (islam et. al. 2010 )। পরবর্তিতে আমি নিজেই এ বিষয়টির উপর এমএস করি। সারা বাংলাদেশের ৬ টি বিভাগের প্রায় ১৫ টি জেলার ৩০ টি আক্রান্ত/সাসপেকটেড ফার্ম হইতে ৩২৪ টি রক্ত নমুনা সংগ্রহ করে সেরো-সারভিল্যান্স স্টাডি করি। আমাকে গাইড করেন প্রফেসর ড. এম. মনসুরুল আমিন এবং কোগাইড ছিলেন প্রফেসর ড. এম. বাহানুর রহমান। আমার এই গবেষনায় দেখা গেছে সংগৃহিত নমুনার প্রায় ৯২% নমুনাতে আইএলটি ভাইরাসের এন্টিবডি পাওয়া গেছে। তার মানে দাড়ালো মুরগি গুলো আইএলটি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। আমার এই থিসিসটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানের একটা ভাল জার্নালে প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।
এছাড়াও বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগে এবং সাভারে অবস্থিত বাংলাদেশ প্রাণি সম্পদ গবেষনা প্রতিষ্ঠানে এই রোগের উপর গবেষনা অব্যাহত আছে। তবে এই দুই প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ ও বেসরকারী পর্যায়ে যারা সরাসরি মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন তারা সকলেই এ বিষয়ে একমত রোগটি বাংলাদেশে বিদ্যমান। তবে অনেকেই মলিকুলার স্টাডি ছাড়া এ রোগের উপস্থিতি মানতে নারাজ, এমনকি এই দুই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের গবেষনাও মানতে নারাজ। মলিকুলার স্টাডি করে আমরা এর সুনির্দিষ্ট ভাইরাস বের করতে পারবো। তাই বলে মলিকুলার স্টাডি ছাড়া এই ভাইরাসের উপস্থিতি নির্নয় করা যাবে না তা কিন্তু নয়। আমাদের দেশে আইবি, এগ ড্রপ সিনড্রম, করাইজা, রিও, গামবোরো, মাইকোপ্লাজমা ইত্যাদি রোগের কোন মলিকুলার স্টাডি আছে আমার জানা নাই। তাহলে এই সকল রোগ কিভাবে নির্নয় করা হলো এবং ভ্যাকসিন কিভাবে দেওয়া হচ্ছে?
একটা রোগের মলিকুলার স্টাডি হলো রোগের জীবানু নির্নযের সর্বশেষ ধাপ। ১ম ধাপ হলো ইতিহাস ও লক্ষন সমূহ, পোষ্টমোর্টেম লক্ষন, ২য় ধাপ হলো আইসোলেশন ও ফিজিকো-কেমিক্যাল চরিত্র নিরুপন, সেরো-সারভিল্যান্স স্টাডি। ১ম ও ২য় ধাপ সম্পন্ন করেই আমাদের দেশে রোগ গুলোর জীবানু আছে ধরে নিয়েই ভ্যাকসিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে হ্যা প্রত্যেকটা রোগের ক্ষেত্রেই জীবানু নির্নয়ের সকল ধাপ সম্পন্ন করে তারপর ঐ জীবানুর বিরুদ্ধে কার্য্যকর ভ্যাকসিন আমদানির সিদ্ধান্ত হওয়া উচিৎ। কিন্তু আমাদের দেশের প্রাণি সম্পদ মন্ত্রনালয় রোগের পূর্বাপর যাচাই বাচাই না করেই শুধু মাত্র কিছু বিদেশী পরামর্শক ও আমদানিকারকদের কথায় ভ্যাকসিন আনার অনুমতি দেয়, যে সংবাদ আমাদের সকলের কাছে আসার আগেই ঐ ভ্যাকসিন থেকেই জীবানুটি মারাত্নক সমস্যার কারন হয়ে দাড়ায়।
তাই আজকে আমার গবেষনা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলছি, বাংলাদেশে আইএলটি রোগটি আছে এবং এর থেকে পোল্ট্রি শিল্পকে বাঁচাতে হলে অবশ্যই লোকাল আইসোলেট থেকে ভ্যাকসিন তৈরী করতে হবে অথবা বাইরে থেকে মান সম্পন্ন ভ্যাকসিন আমদানি করতে হবে। অন্যথায় আমাদের পোল্ট্রি শিল্পের অব্যাহত ক্ষতি চলতেই থাকবে। ধন্যবাদ।
সারোয়ার ভাইকে ধন্যবাদ। সময় উপযোগি একিট বিষয়ের উপর গবেষণা এবং তা এত কষ্ট করে বাংলায় লেখে প্রকাশ করার জন্য। অত্যন্ত দুঃখের সাথে মনে প্রশ্ন জাগে, দেশের এত বড় ক্ষতি যারা করে তারা কি বরাবরই ধরা ছোঁয়ার বাইের থেকে যাবে? দেখার কি কেউ নেই? বতর্মানে ভেট প্রফেশনে দায়িত্বশীল সিনিয়র নেতৃত্বের বড়ই অভাব বোধ করছি। মাঝে মাঝে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। আবার তারুন্যের শক্তি আমাকে আশা জাগায়। আমার বিশ্বাস তরুনরাই পারবে ভেট প্রফেশনের এই অচলায়তন ভাংতে।
Tnx a lot….to clear the confusion…..among most common respiratory disease
আপনার এই রোগের ব্যাপারে গভেষনা সম্পর্কে জেনে ভাল লাগল। আমার ও কিছু মুরগি আছে। তার মধে্য একটি মুরগির একই সমস্যা।