১ম পর্বে আমাদের জীবনে পোল্ট্রী শিল্পের কি অবদান তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। যারা ১ম পর্বটি পড়েননি তারা এখানে ক্লিক করে সেটা পড়ে নিতে পারেন।
আজকের পর্বে আমি যা তুলে ধরতে চাচ্ছি তা হলো-
১। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকারের গৃহিত পদক্ষেপ সমূহ
২। বাংলাদেশে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমনের বিভিন্ন পরিসংখ্যান ( বছর অনুযায়ী বানিজ্যিক খামার, পারিবারিক খামার, প্যারেন্ট স্টক-এ সংক্রমন) ও তার বিশ্লেষন
৩। কি কি কারণে আমরা এখনও এই রোগ থেকে মুক্ত হতে পারলাম না
এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রনালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়, ওআইই (OIE), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (FAO) – এর সমন্বয়ে গৃহিত পদক্ষেপ সমূহঃ
১। আক্রান্ত খামার সনাক্তকরনণ ও খামারের সমস্ত মুরগি নিধন এবং ডাম্পিং ও লিটার জীবানু মুক্তকরণ,
২। আক্রান্ত খামারের আশপাশে কমপক্ষে এক কিলোমিটার এর মধ্যে সমস্ত বানিজ্যক খামার, দেশী হাঁস-মুরগির উপর নজরদারী ও জীবনিরাপত্তা বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরী ও বিনামূল্যে জীবানু নাশক স্প্রে,
৩। আক্রান্ত খামারের নিধনকৃত মুরগির ক্ষতিপূরন প্রদান,
৪। খামারের সকল কর্মকর্তা, কর্মচারী, নিধনকারী দলের সকলকে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধী এন্টি-ভাইরাল প্রদান ও নজরদারী,
৫। নিধনকৃত খামারে কমপক্ষে ৪২ দিনের মধ্যে কোন মুরগি উঠানো যাবে না
৬। জেলা প্রশাসক, প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা, জেলা পুলিশ সুপার, জেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা সিভিল সার্জন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের একটি দল এই বিষয়গুলি যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় তা সমন্বয় করে থাকেন।
বাংলাদেশে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমনের অবস্থা (২২/০১/১২ তারিখ পর্যন্ত)
আক্রান্ত জেলাঃ ৫২।
আক্রান্ত উপজেলাঃ ১৬২।
মোট আক্রান্ত খামারঃ ৭৯৩; বাণিজ্যিক- ৭৩৬, পারিবারিক- ৫৭
মোট ধ্বংস করা খামারঃ ৫৩৩; বাণিজ্যিক- ৪৭৬, পারিবারিক- ৫৭
মেরে ফেলা মুরগীর সংখ্যাঃ ২৪,৮৮,৬২৭ টি।
ধ্বংস করা ডিমের সংখ্যাঃ প্রায় ১৬ লক্ষ ।
বেকার হয়ে পড়া লোকজনের সংখ্যাঃ প্রায় ১৫ লক্ষ।
পোল্ট্রি শিল্পের মোট ক্ষতিঃ প্রায় ১৮০০০ কোটি টাকা।
প্রতিবছরে ধ্বংস করা বানিজ্যক খামার ও পারিবারিক খামারের সংক্রমনের অবস্থা(২২/০১/১২ পর্যন্ত)
বছর | বাণিজ্যিক | পারিবারিক | মোট |
২০০৭ | ৪৪ | ২৫ | ৬৯ |
২০০৮ | ২০৮ | ১৮ | ২২৬ |
২০০৯ | ২৩ | ০৯ | ৩২ |
২০১০ | ২৯ | ০২ | ৩১ |
২০১১ | ১৬২ | ০৩ | ১৬৫ |
২০১২ | ১০ | – | ১০ |
সর্বমোট | ৪৭৬ | ৫৭ | ৫৩৩ |
বিভাগীয় পর্যায়ে সংক্রমনের চিত্র(২২/০১/২০১২ পর্যন্ত)
বিভাগ | সংক্রমিত খামারের সংখ্যা |
ঢাকা | ৩৯৬ |
চট্রগাম | ১০৭ |
রংপুর | ৯৫ |
রাজশাহী | ৭৫ |
খুলনা | ৬২ |
বরিশাল | ৫৩ |
সিলেট | ০৫ |
সর্বমোট | ৭৯৩ |
এবার এই শিল্পের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে আমরা কি দেখতে পাই?
২০০৭ সালে ২১ মার্চ বিমান বাংলাদেশ ব্রীডার ফার্মে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা নির্ণয়ের আগের ও পরের চিত্র নিম্নে দেওয়া হলো-
বাণিজ্যিক খামারের চিত্র
সাল | বানিজ্যক খামারের (লেয়ার +ব্রয়লার) সংখ্যা |
২০০৬ –২০০৭ | ১,৪৯,০০০ |
২০০৭–২০০৮ | ৭৬,০০০ |
২০০৮–২০০৯ | ৯৭,০০০ |
২০০৯–২০১০ | ১,১৩,৬১৩ |
২০১১–২০১২ | ৬০,৮২৪ |
দেশে উৎপাদিত ও বিদেশ হতে আমদানিকৃত প্যারেন্ট ষ্টকের চিত্রঃ
সাল | লেয়ার প্যারেন্ট | ব্রয়লার প্যারেন্ট |
২০০৬ | ৩,৩০,০০০ | ২৩,০৪,৩১১ |
২০০৭ | ৩,৫০,০০০ | ২৯,৭৯,৮৫৫ |
২০০৮ | ২,৭৬,০০০ | ২৩,০২,৮৯৬ |
২০০৯ | ৪,৩০,০০০ | ২১,৯৩,০০০ |
২০১০ | ৪,৭৫,০০০ | ২৭,৮০,০০০ |
২০১১ | ৩,৫০,০০০ | ৩৩,৬৪,৪৮৮ |
উপরের কার্য্যক্রমগুলো ২০০৭ সালের মার্চ হইতে শুরু হয়ে আজ অব্দি চলছে কিন্তু ফলাফল দিন দিন অবনতির দিকেই যাচ্ছে। শুরুতে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে নিধনকৃত মুরগির মূল্য বাজার মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য থাকায় ও সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারনে ২০০৯ ও ২০১০ সালে কিছুটা সাফল্য পেলেও পরবর্তিতে সরকারের কিছু ভূল সিদ্ধান্তের কারনে মুরগির ক্ষতিপূরনের টাকা বাজার মূল্য থেকে কমিয়ে দেওয়া হয় এবং প্রতিশ্রুত টাকা প্রদানের দীর্ঘসুত্রিতার জন্য এবং ইদানিং কালে ক্ষতিপূরনের টাকা পাওয়ার অনিশ্চয়তার কারনেই খামারীরা মৃত ও অসুস্থ্য মুরগি সরকারকে না জানিয়ে বাজারে ও গ্রামে, গঞ্জে বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলে ২০১১ সালের নবেম্বর থেকে এই রোগ আবার মারাত্নক আকার ধারন করেছে এবং বর্তমানে তা অব্যাহত আছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ বানিজ্যিক খামার বন্ধ হয়ে গেছে এবং প্রায় ৫৯ শতাংশ ব্রীডার ফার্ম প্যারেন্ট শুন্য হয়ে পড়েছে। দেশে ছোট বড় প্রায় ১৫০ টিরও বেশী ব্রীডার ফার্ম থাকলেও বর্তমানে মাত্র ৫/৬ টি হ্যাচারী থেকে একদিন বয়সী লেয়ার বাচ্চা সরবরাহ করা হচ্ছে, বাকী সব বন্ধ আছে। ব্রয়লার ব্রীডার ফার্মের বেলায়ও একই অবস্থা। দেশে উৎপাদিত ব্রয়লার জিপি থেকে প্যারেন্ট পেলেও তা খুবই কম। এ অবস্থা চলতে থাকলে এই বছরের মাঝামাঝি থেকে দেশে তীব্র আকারে ডিম ও মুরগীর মাংসের ঘাটতি দেখা দেবে।
এবার আসি কেন এবং কি কারনে আমরা এই মারাত্মক ব্যাধী থেকে এখনও বের হতে পারলাম না তার প্রধান প্রধান কিছু কারন দেখি-
১. ২০০৭ থেকে ২০১১ এই দীর্ঘ সময়েও পোল্ট্রির একটি সমন্বীত নিতিমালা তৈরী করতে না পারা অথবা থাকলেও সে অনুযায়ী খামার করার ও মুরগি পালনের জন্য খামার মালিকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করতে না পারা অথবা বাধ্য করতে না পারা
২. প্রয়োজণীয় জীব-নিরাপত্তার বিধি বিধান মেনে না চলার প্রবনতা রোধ করতে না পারা
৩. বানিজ্যিক খামারের মতো দেশীয় হাঁস মুরগি, সোনালি ও ফাহমি জাতের মুরগির প্রয়োজনীয় পুষ্টি যুক্ত খাদ্য না দেয়া ও কার্য্যকর ভ্যাকসিনের আওতায় না নিয়ে আসা অথবা ধীরে ধীরে এসব পালন থেকে বিরত না রাখা।
৪. উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন পর্যায়ে সারা বছর ব্যাপি একটি কার্য্যকর পরিদর্শক দল দ্বারা (যা সরকার পরিচালিত) ঐ অঞ্চলের সকল বানিজ্যিক ও পারিবারিক খামার তীক্ষ্ম নজরদারিতে না রাখা
৫. নিধনকৃত মুরগির দাম বাজার মূল্য থেকে কম ও ক্ষতিপূরনের টাকা প্রদানের দীর্ঘসুত্রিতা
৬. কৃষিখাতের মতো এই খাতে ভর্তুকি না থাকা ও বিনা শুল্কে পোল্ট্রি খাদ্য পন্য সরবরাহ নিশ্চিৎ না করা
৭. এই খাতে বীমার ব্যবস্থা না করা
৮. ডিম, মুরগির বাচ্চা, মুরগির মাংসের দাম সারা বছর ব্যাপি যেন প্রায় একই রকম থাকে সেই ধরনের কোন ব্যবস্থা না নেওয়া
৯. শুরু থেকেই গৃহিত চলমান প্রক্রিয়ার পাশাপাশি এই সেক্টরের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে ডেকে আমাদের দেশের অবস্থার কথা চিন্তা করে এই সেক্টরকে কিভাবে রক্ষা করা যায় তা গবেষনা করে বের করার জন্য প্রস্তুতি নিতে না বলা
১০. কেবল মাত্র বিদেশী অর্থ সাহায্য নেওয়া ও তাদের গৃহিত নীতিমালা অনুসরণ করে চলা
১১. আমাদের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ সহ অন্যান্য ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়, BLRI, LRI এর বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি করে এর একটি গ্রহনযোগ্য ও কার্য্যকর উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা না করা অথবা এ বিষয়ে কোন কাজ করার অনুমতি না দেওয়া
১২. চোরাই পথে এই রোগকে প্রতিরোধ করতে পারবে এমন ধরনের অকার্য্যকর মেডিসিন ও ভ্যাকসিন যারা আনেন এবং যারা এর সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন না করা।
১৩. সরকারের অদক্ষ ও অযোগ্য লোকবলের দ্বারা কর্মকান্ড পরিচালনা করা ও অতিমাত্রায় বিদেশী নির্ভরশীল হওয়া
১৪. সরকারী, আধাসরকারী, বেসরকারীভাবে এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে এই রোগ নির্নয়ের সুযোগ না রাখা।
১৫ দেশী মুরগি পালন যেখানে ঝুঁকিপূর্ন সেখানে সরকারীভাবে এখনও ৫০-১০০ মুরগি বিনামূল্যে ক্ষুদ্র খামারীদের মাঝে বিতরন করা যা এই রোগের জন্য আরও সমস্যার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৬. আমদানিকৃত ও দেশে উৎপাদিত ঔষধ, ভ্যাকসিন, ভিটামিন ও মিনারেল সমূহ এর গুণগতমান যাচাইয়ের জন্য কার্য্যকর কোন ল্যাব স্থাপনের পদক্ষেপ গ্রহন না করা।
১৭. সরকারের মন্ত্রনালয়গুলোর মধ্যে চরম সমন্বয়হীনতা । যেমন- কৃষি মন্ত্রনালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রোধ না করা। কৃষি মন্ত্রনালয় ও মৎস্য অধিদপ্তর থেকে এখনও মানুষকে সমন্বীত চাষ পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে। যেখানে পুকরে মাছ ও উপরে মুরগি পালন অথবা মাছ ও হাঁস পালন করা হচ্ছে। আবার কোথাও ধান খেতে হাঁস ও মাছ চাষ ইত্যাদি। এই বিষয় গুলি একটা সুন্দর পদ্ধতির আওতায় না নিয়ে আসা।
প্রিয় পাঠক, এই ছিল আজকের পর্বের বক্তব্য।
৩য় ও শেষ পর্বে আছে কিভাবে আমরা এই এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার করাল গ্রাস থেকে আমাদের পোল্ট্রী শিল্পকে রক্ষা করতে পারি । পড়তে ক্লিক করুন এখানে।
১ম ও ২য় পর্ব পড়ার পর আপনারা যারা মন্তব্য করে আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছেন তাদের প্রতি রইল আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। আশা করি এই ধারা আপনারা বজায় রাখবেন। সবাইকে আবারও ধন্যবাদ।
সরোয়ার ভাই, দারুন, এক কথায় অসাধারণ, তবে তথ্যগুলোর উৎস দিলে ভালো হতো। আশা করি পরের পর্বে উৎসগুলি যুক্ত করে দিবেন।
ধন্যবাদ তায়ফুর, ৩য় পর্বে উৎস দিয়ে দেব।
Very nice and informative article.
অনেক ধন্যবাদ। আমি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ও এ বিষয়ে যাদের কারিগরি জ্ঞান আছে তাদের সবার কথাই তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমি মনে করি এদেশে পোল্ট্রী শিল্পের কি অবদান তা তাদের জানা উচিৎ।
ভাইয়া, খুব ইনফরমাটিভ আরটিকেল…..। very nice……..
তোমাকে ধন্যবাদ। পারলে সাহা্য্য করো।
sarwar how r u ? nice and valuable artical please continue such type….
Jashim vai apnak donnobad
nice information………………………..thanks for your article
thank you also for your nice comment.
Article ti nice, informative, valuable, somoyupojogi. Sob thik ache. Sudhu etotuku bolei kintu amader responsibility shesh korlay cholbay na. We should add our idea, suggestions to overcome the problem that stated in the article.
Excellent and very practical article. I congratulate you. Let’s try to implement it.
Thank you sir for your nice comments. Actually we can write or try but implementation is in Hand of Govt. I think the all words of the article are the words of peoples of Bangladesh to save the sector. I have just write sir.
তায়ফুর ভাইয়ের সাথে মিলিয়ে বলতে হয় অসাধারণ