সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে আমিষ

স্বল্প আয়ের পরিবারে বাসাভাড়াসহ অন্যান্য খরচ মেটানোর পর কাঁচাবাজারের জন্য বাজেট থাকে সামান্যই। সেই টাকা দিয়ে যত দূর নাগাল পাওয়া যায় তাতে দেশি প্রজাতির মাছ ও মুরগির লেজও ধরা যায় না। কম দামের তেলাপিয়া আর পাঙ্গাশ খেতে খেতে যারা বিরক্ত, তারা স্বস্তি খোঁজে ব্রয়লার মুরগিতে। সেই মুরগির কেজিও এখন ১৬৫ টাকা। ফার্মের মুরগির ডিমের হালি উঠেছে ৩৬ টাকায়। ফলে প্রাণিজ আমিষ চলে যাচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। কয়েক মাস ধরে মাছ, মাংস, দুধ ও ডিমের দাম একসঙ্গে বাড়ছে। ফলে মাংস বাদ দিয়ে মাছ অথবা মাছ বাদ দিয়ে ডিম খেয়ে খরচ কমানোর উপায় নেই। প্যাকেটজাত গুঁড়োদুধের দামও বাড়ছে লাগামহীনভাবে। প্রাণিজ আমিষের উৎসগুলোর দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সরবরাহ কমে যাওয়া, ডলারের উচ্চমূল্য, পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া ও বরফের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের মতে, মাছ, মাংস, ডিম ও দুধের দাম বাড়ার আলাদা কারণ আছে। তবে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে সব পণ্যের ওপর। তেলের দাম বাড়ায় পণ্য পরিবহন খরচ বেড়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ায় বরফ, ডিম ও মাংস উৎপাদনের খরচও বেড়েছে। আর বরফ উৎপাদন খরচ বাড়ার সরাসরি প্রভাব পড়েছে মাছের দামে। বর্তমানে ঢাকার বাজারে এক কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৬০-১৬৫ টাকায়। সাধারণ সময়ে যার দাম ১২০-১২৫ টাকার মধ্যে থাকে। ২৪ টাকা হালি দরে ডিম কিনতে অভ্যস্ত মানুষ এখন কিনছে ৩৫-৩৬ টাকা দরে। গরুর মাংস কেজিপ্রতি ২৮০ টাকা ও মাঝারি আকারের দেশি মুরগি প্রতিটি ৩৫০-৪০০ টাকা দরে বিকোচ্ছে খুচরা বাজারে। নানা প্রজাতির মাছের মধ্যে সবচেয়ে সস্তা ছিল পুকুরে চাষ করা পাঙ্গাশ ও তেলাপিয়া। পাঙ্গাশ কয়েক মাস আগেও ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যেত। এখন বিক্রি হয় ১২০-১৪০ টাকা দরে। আর ১০০ টাকা কেজির তেলাপিয়া এখন ১৪০-১৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়। গুঁড়ো দুধের দাম কেজিপ্রতি বেড়ে এখন প্রায় ৫০০ টাকার কাছাকাছি উঠে গেছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এক বছর আগের তুলনায় বর্তমানে ডিমের দাম ৫৫.৫৬ শতাংশ, রুই মাছ ২৫ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগি ১৮.৩৭ শতাংশ ও গুঁড়ো দুধের দাম প্রতি কেজিতে ৫০-৮৫ টাকা বেড়েছে। বরফ আর পরিবহন খরচে বেড়েছে মাছের দাম : মাছের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ, উৎপাদন কমে যাওয়া। তবে সার্বিকভাবে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে পরিবহন খরচ ও বরফের দাম বাড়ার কারণে। আমদানি করা রুই মাছ কয়েক মাস আগেও ১৬০-১৮০ টাকার মধ্যে পাওয়া যেত। আর দেশি প্রজাতির চাষ করা বড় রুই বিক্রি হতো ১৮০-২০০ টাকা। বর্তমানে আমদানি করা রুই ২০০-২৫০ টাকা ও দেশি রুই ২৫০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর বাজারে। প্রাকৃতিক জলাশয়ের কই, শোল, টেংরা, মিনি, পুঁটি ইত্যাদি মাছ ৩০০ টাকা কেজির নিচে মিলছে না। আর চাষ করা কই বিক্রি হচ্ছে ২০০-২৫০ টাকা কেজি দরে। সব মিলিয়ে মাছের দাম এখন ২০-৩০ শতাংশ বাড়তি বলে জানান ব্যবসায়ীরা। ঢাকা মাছ ও কাঁচাবাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন সিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, চৈত্র মাসে প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো শুকিয়ে যায়। এ কারণে মাছের সরবরাহ কম। আবার ইলিশ সাধারণত অন্য মাছের চাহিদা কমিয়ে রাখে, কিন্তু এখন এই মাছ ধরা বন্ধ। আবার নববর্ষ উপলক্ষে বিক্রির জন্য ইলিশ হিমাগারে রাখা হচ্ছে। সব মিলিয়ে সংকটের কারণেই দাম বেড়েছে। তবে সার্বিকভাবে মাছের দাম আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে বলে উল্লেখ করেন আনোয়ার হোসেন। এর কারণ হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে তিনি বলেন, গত বছর সাতক্ষীরা থেকে একটি ট্রাকের ভাড়া ছিল ১২ হাজার টাকা, এখন সেটা ১৯ হাজার। বরিশাল থেকে এক লঞ্চে এক ঝুড়ি মাছের ভাড়া ছিল ৬০ টাকা, এখন সেটা ১৫০ টাকা। সদরঘাট থেকে কারওয়ান বাজারে আসতে ভাড়া দিতে হতো ১০০ টাকা, এখন সেটা ২৫০। এভাবে সব জায়গায় পরিবহন খরচ বেড়েছে। বিদ্যুতের কারণে বরফের দাম বেড়েছে বলে জানিয়ে আনোয়ার হোসেন বলেন, আইসক্রিমের কারখানা থেকে আগে যে বরফ ১৫০ টাকায় পাওয়া যেত এখন সেটা ২৫০-৩০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আর বরফ কলের বড় আকারের একটি চাকতি গত বছর ৩০০ টাকায় মিলত, এখন সেটা কিনতে লাগছে ৭০০ টাকা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ১৭ টাকা বেড়েছে। আর বিদ্যুতের দাম গত এক বছরে চার দফা বাড়ানো হয়। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৬৫ টাকা : উচ্চ উৎপাদন খরচের মধ্যে বার্ড ফ্লুর আক্রমণে বন্ধ হয়ে গেছে হাজার হাজার ছোট ও মাঝারি খামার। এরই ফলে সরবরাহ সংকটে দাম বেড়েছে ব্রয়লার মুরগি ও ফার্মের ডিমের, যার প্রধান ক্রেতা নিম্ন আয়ের মানুষ। বছরের অন্য সময় ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিপ্রতি ১২০-১২৫ টাকা থাকে; কিন্তু এখন সেটা ১৬০-১৬৫ টাকা। এক কেজি মুরগি কিনলে মাংস হিসেবে টেকে ৭৫০ গ্রাম। ফলে মুরগির প্রকৃত দাম দাঁড়ায় ২০০ টাকা। মুরগি কিনে তার গিলা-কলিজা, পা-চামড়া ফেলে দেয় ঢাকার ফাস্টফুডের দোকান, হোটেল মালিক ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলো। সেগুলোর বড় ক্রেতা আবার নিম্ন আয়ের মানুষ। মুরগির পাশাপাশি ওই পা-চামড়া ও গিলা-কলিজার দামও বেড়েছে। আগে এগুলোর কেজিপ্রতি দাম ছিল ৬০-৭০ টাকা, এখন সেটা ৮০-১০০ টাকা। ডিমের হালি দীর্ঘদিন ২২-২৪ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। চলতি বছরের শুরুতে দাম বাড়তে শুরু করে। ২৪ থেকে বেড়ে বর্তমানে ফার্মের ডিমের হালি ৩৬ টাকা। তবে বড় বাজারে এক ডজন কিনলে ৩৪-৩৫ টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে। এত দিন দেশি হাঁসের ডিম ৩৫ টাকা হালি দরে বিক্রি হতো, এখন সেটা ৩৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. মহসিন কালের কণ্ঠকে বলেন, বার্ড ফ্লুর আক্রমণে বহু খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণেই মুরগি ও ডিমের দাম বেড়েছে। দুধের দাম ব্যাপক চড়া : ডিসেম্বর মাসের পর থেকেই দেশে ডলারের দাম বাড়ার কারণ দেখিয়ে গুঁড়ো দুধের দাম বাড়ানো শুরু হয়। এ সময় প্রতি কেজিতে এই শিশুখাদ্যের দাম ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে দেশি ও বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো। কিন্তু এই দাম বাড়ানো যৌক্তিক কি না তা একবারের জন্যও তদারকি করে দেখেনি সরকারের কোনো সংস্থা। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে নেসলে কম্পানির বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দুধের দাম। এ কম্পানির ৪০০ গ্রাম ওজনের ন্যানো-১ ও ন্যানো-২-এর দাম বেশি বেড়েছে। ডিসেম্বরে এর দাম ছিল ৬২৯ টাকা। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। টিসিবির তালিকায় দেখা যায়, এক বছরে অন্যান্য ব্র্যান্ডের গুঁড়ো দুধের দাম কেজিতে ১৩ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ডানো ব্র্যান্ডের গুঁড়ো দুধের দাম আগে ছিল ৪৯০-৫০০ টাকা, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৫৮০-৫৮৫ টাকা। একইভাবে ডিপ্লোমা কেজিতে ৬০-৭০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৫৬০-৫৭০ টাকা, ফ্রেশ ৫০-৬০ টাকা বেড়ে ৪৭০-৪৮৫ টাকা ও মার্কস একই হারে বেড়ে ৪৭৫-৪৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সেরেলাক ৪০০ গ্রামের প্যাকেট ৩২০ থেকে বেড়ে ৩৪০ টাকা হয়েছে। গুঁড়ো দুধের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করছে। নিউজিল্যান্ড উেইরি প্রোডাক্টসের হেড অব মার্কেটিং জিএম কামরুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডলারের দাম যে হারে বেড়েছে গুঁড়ো দুধের দাম সে হারে বাড়ানো যায়নি। গত বছর ডলারের দাম টাকার বিপরীতে প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। আবার সিঙ্গাপুরের ডলারের দাম যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের তুলনায় বেড়েছে। ফলে দুই দিক দিয়ে আমাদের বেশি খরচ হচ্ছে।’ গুঁড়ো দুধের পাশাপাশি তরল দুধের দাম বেড়ে এখন প্রতি লিটার ৫৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। যদিও বিভিন্ন উৎসবে সংকট হলেই তরল দুধের লিটার ৭০-৮০ টাকায় উঠে যায়।


 

সূত্র: রাজীব আহমেদ: কালের কন্ঠ: ৩১.০৩.১২ প্রথম পাতা

লেখকঃ ডা.ওসমান গনি শিশির

Scientific Officer, Ranikhet Vaccine Section, Livestock Research Institute(LRI), Mohakhali, Dhaka. Former Veterinary Surgeon,Upazila livestock Office, Thakurgaon Sadar, Thakurgaon. Former Senior Scientific Officer, livestock Division, Bangladesh Agricultural Research Council (BARC), Farmgate, Dhaka. Former Scientific Officer, Poultry Disease Diagnostic Laboratory, BLRI, Savar, Dhaka. Former Scientific Officer, (Sheep Health) , Goat & Sheep Production Research Division, BLRI, Savar, Dhaka. DVM, 2003 (BAU); MS in Microbiology 2007 (BAU). Cell: 01716-022840 Email: shishir.micro@yahoo.com; www.drosmanshishir.wordpress.com

এটাও দেখতে পারেন

প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে অনলাইন গবাদি পশু শনাক্তকরণ এবং নিবন্ধন ব্যবস্থা চালুঃ জানা যাবে স্বাস্থ্য ও রোগের ইতিহাস

প্রাথমিকভাবে ৫০,০০০ পশু নিবন্ধিত হবে যা গ্রাহকদের পশুগুলোর স্বাস্থ্য ইতিহাস দেখার সুযোগ দিবে। প্রথমবারের মতো, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.