কেস স্টাডি ০১
জনাব মোঃ কবির বিশ্বাস একজন অবস্থা সম্পন্ন কৃষক। তাদের একটি বড় দুগ্ধ খামার আছে যা তার ছোট ভাই দেখাশুনা করেন। জনাব কবিরের ভেটেরিনারী মেডিসিনের দোকান আছে এর পাশাপাশি ৩৫/৪০ টি’র মতো গাড়ল জাতের ভেড়া আছে। নদী তীরবর্তী তাদের বাড়ি হওয়ায় ভেড়ার চরে খাওয়ার যতেষ্ট সুবিধা আছে। এ কারনে ভেড়া পালনের জন্য একটি রাখাল রেখেছেন। ভেড়ি বাচ্চা প্রসবের পর বাচ্চা খোঁজাকরনের বয়সের আগেই প্রায়ই কিছু বাচ্চা মারা যায়। রাতে ফ্লোরে বা ঘরের মেঝেতে ভেড়া রাখা হয়। কখনো কৃমিনাশক বা সম্পুরক খাদ্য সরবরাহ করা হয় না। এ বিষয় নিয়ে তিনি উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে যোগাযোগ করেন। উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে মাচাতে এবং তা সম্ভব না হলে ফ্লোরে শুকনা খড় বিছিয়ে ভেড়া রাখার জন্য এবং নিয়মিত কৃমিনাশক খাওয়ানোর পরামর্শ প্রদান করা হয়। তাছাড়া প্রসবের পর ভেড়ার বাচ্চা পুষ্টিহীনতায় ভুগে ফলে কিছু সম্পুরক পুষ্টি সরবরাহের পরামর্শ প্রদান করা হয়। পরামর্শ মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার পর বাচ্চা মৃত্যুহার কমে যায়।
কেস স্টাডি ০২
মরিয়ম বেগম দরিদ্র মহিলা। রিক্সাচালক স্বামীর একার উপার্জনে সংসার নির্বাহ করা দুরহ হয়ে পড়ায় ছাগল ও ভেড়া পালন শুরু করেন। এক সময় ভেড়া রেখে ছাগল বিক্রি করে দেন। এখন তার পালে ছোট বড় মোট ৪৩ টি ভেড়া রয়েছে। তিনি জানান প্রতি মাসে তার পালে দুই তিন টা ভেড়া বাচ্চা প্রসব করে।ভেড়া পালন করতে যেয়ে তার সবচেয়ে বড় সমস্য হলো বাচ্চা মারা যাওয়া এবং ভেড়ার চর্ম রোগ হওয়া। এ দুটি সমস্যা তার পিছু ছাড়ে না। অনেক গ্রাম্য ডাক্তারের পরামর্শ ও চিকিৎসা নিয়েও সমস্যার সমাধান না হওয়ায় তিনি উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে যোগাযোগ করেন। প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে ভেড়াকে নিয়মিত কৃমিনাশক খাওয়ানো ও প্রসবের পর বাচ্চাকে শাল দুধ এবং একটি নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত দুধ বা দুধের বিকল্প পুষ্টি সরবরাহের পরামর্শ দেয়া হয়।
গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, হাঁস, মুরগি, কবুতর প্রতিটি প্রাণিসম্পদের অংশ হলেও আমরা প্রাণিসম্পদ বলতে কেবল গরু, ছাগল এবং মুরগিকে বুঝে থাকি এবং আমাদের সমাজ সংস্কৃতিতে ভেড়া এবং ভেড়া পালন বিষয়ে তেমন আলোচনা নেই। তাই ভেড়া নিয়ে আমাদের জানা ও জ্ঞানের বিষয়টি রয়েছে অনেকটাই অগোচরে। ভেড়া বর্তমানে একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রাণি মনে হলেও অনসন্ধানে দেখা গেছে আমাদের দেশে এখনো বিপুল সংখ্যক ভেড়া রয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে অজানা অনেক বিষয়ের মতো ভেড়া পালনের প্রয়োজনীয়তা আজ আমাদের সামনে দাড়িয়েছে। ভেড়া একটি অবহেলিত প্রাণি হিসাবে পরিচিত তবে একটি লাভজনক প্রাণি। ভেড়া একটি বহুমুখী ব্যবহার উপযোগী (multi-purpose) প্রাণি এবং পৃথিবীতে প্রায় ২০০ এর অধিক ভেড়ার জাত রয়েছে। FAO এ কর্তৃক কয়েক’শ ভেড়ার জাত সনাক্ত করা হয়েছে। উপযোগিতা অনুসারে উল, মাংশ, দুধ, চামড়া উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে ভেড়ার জাতকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। অন্যান্য বৈশিষ্ট্য যেমন মুখের রঙ, লেজের দৈর্ঘ্য, শিং এর উপস্থিতি এমন কি topography উপর ভিত্তি করে ভাগ করা হয়েছে। আফ্রিকা ও এশিয়ায় এক ধরনের ভেড়া পাওয়া যায় যাকে fat-tailed type ভেড়া বলে কারন এ ধরনের ভেড়ার লেজের আশে পাশে বেশি চর্বি জমা হয়। চিকন উল, লম্বা উল, মোটা ইত্যাদি টাইপের উল উৎপানের ভিত্তি করেও ভেড়ার শ্রেণি বিভাগ করা হয়েছে।
ভেড়া পালন ব্যবস্থাপনা ঃ ভেড়া ও ছাগল পালনের মধ্যে তেমন কোন তফাৎ নেই। তবে ছাগল পালনের চেয়ে ভেড়া পালন ব্যবস্থাপনা সহজ। নিম্নে আমাদের দেশে ভেড়া পালনকারী মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার আলোকে ভেড়া পালনের সাধারন কিছু বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
ভেড়ার বাসস্থান ঃ প্রত্যেক জীবের প্রথম ও প্রধান মৌলিক চাহিদা হলো একটি আরামদায়ক বাসস্থান। আমাদের দেশে যেসব কারনে ভেড়ার মৃতু ঘটে (mortality) তার মধ্যে অন্যতম হলো বাসস্থান না থাকা বা অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান। ভেড়ার রাখার জন্য অধিকাংশই কৃষকেরই ভালো ঘর নেই। তাছাড়া ২০/৩০ টি’র বেশি ভেড়া আছে এমন খামারীদের ভেড়ার জন্য স্বাস্থসম্মত বাসস্থান নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পারিবারিকভাবে পালিত ভেড়া রাখা হয় কৃষকের ঘরের মাচা বা চৌকির নীচে বা ঘরের পাশে ছোট্ট একটি চালা বেধে তার মধ্যে যেখানে আলো বাতাস প্রবেশের সুযোগ কম। কিন্তু সামান্য খরচ করেই ভেড়া রাখার জন্য একটি স্বাস্থসম্মত বাসস্থান তৈরি করা যায়। ছাগল বা ভেড়া বাসস্থান তৈরির সময় একটি বিষয় খেয়াল রাখা খুব জরুরী আর তাহলো মেঝে তা কাঁচা বা পাকা যেমনই হোক সেখানে ভেড়া না রেখে মাচা বা স্লাট এর উপর ভেড়া পালন করা।
ভেড়ার খাদ্য ব্যবস্থাপনা ঃ একটি প্রবাদ আছে “ছাগলে কি না খায়…”। আসলে কি তাই, ছাগল কি সবকিছু খায় ? ছাগল শুধু ঘাসের আর গাছের ডগা খায়।কিন্তু ভেড়া সবকিছু খায়। ভেড়া একটি সর্বভূক প্রাণি। শুকনা খড় থেকে শুরু করে গরুর খাদ্যের উচ্ছৃষ্টাংশ পর্যন্ত খায়। তাই ভেড়া পালনে খাদ্য খরচ কম। ভেড়া একটি তৃণভোজী স্তন্যপায়ী প্রাণি। ভেড়া সাধারণত: চরে খেতে পছন্দ করে এবং ছাগলের মতো কোন গাছের মাথা বা ঘাসের ডগা নয় ঘাসের নীচের অংশ থেকে খাওয়া শুরু করে। ভেড়ার অন্যান্য রোমন্থক প্রাণির ন্যয় চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট পরিপাকতন্ত্র এবং ভেড়া আশঁ জাতীয় খাদ্য, লতা-পাতা প্রভৃতিকে সহজেই সাধারণ শর্করা তে পরিনত করতে পারে। এছাড়া ভেড়া স্বাভাবিক এবং প্রতিকুল উভয় অবস্থাতে’ই শুকনা খড় এবং খড় জাতীয় খাদ্য গ্রহন করে থাকে। আমাদের দেশে ভেড়ার চরে খাওয়ার মতো পর্যাপ্ত খাদ্য নেই। তাছাড়া বর্তমান সময়েও আবদ্ধ পদ্ধতিতে ভেড়া পালন একটি বিরল ঘটনা। গরু, ছাগল এবং পোল্ট্রি আবদ্ধ পদ্ধতিতেও পালন করা হয় এবং এ জন্য তাদের দানাদার খাদ্য সরবরাহ করা হয়। যেহেতু চরে খেয়ে প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রাপ্তি ঘটে না তাই বয়স ভেদে নিম্নোক্ত মিশ্রনের দানাদার প্রতিদিন ২০০-৩০০ গ্রাম হারে খাওয়ানো যেতে পারে।
বাচ্চা, বাড়ন্ত এবং বয়স্ক ভেড়ার জন্য দানাদার খাদ্য মিশ্রনে নমুনা (%) ঃ
ক্রমিক নং | খাদ্য উপাদান (কেজি) | বাচ্চা ভেড়া (৩-৬ মাস) | বাড়ন্ত ভেড়া (৭-১৫ মাস) | বয়সক ভেড়া (১৫ মাস হতে) |
১ | চাল/গম/ভূট্টা ভাংগা | ৩০ | ১৫ | ১০ |
২ | বিভিন্ন ধরনের ডালের ক্ষুদ | ৫ | – | – |
৩ | গমের ভুষি/চালের কুড়া | ২৯ | ৪৫ | ৫০ |
৪ | ডালের ভূষি/ খোসা | ৫ | ১৫ | ১৫ |
৫ | খৈল | ২৫ | ২০ | ২০ |
৬ | প্রোটিন কনসেন্ট্রট | ২.৫ | ১ | ১ |
৭ | ডিসিপি/ঝিনুক চূর্ণ/ডিমের খোসা | ২ | ২ | ২ |
৮ | লবণ | ১ | ১.৫ | ১.৫ |
৯ | ভিটামিন মিনারেল প্রিমিক্স | ০.৫ | ০.৫ | ০.৫ |
মোট | ১০০ | ১০০ | ১০০ |
রোগ বালাই ঃ ভেড়ার রোগ বালাই তেমন হয় না। তবে এন্টরোটক্সিমিয়া, আমাশায়, ধনুষ্টংকার, ক্ষুরা, একথাইমা, পিপিআর, নিউমোনিয়া ইত্যাদি রোগ হতে পারে।ভেড়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যকরণীয় বিষয় হলো নিয়মিত কৃমিনাশক ব্যবহার করা। গোলকৃমি, ফিতাকৃমি, কলিজাকৃমি ভেড়াকে আক্রান্ত করে। প্রতি ২/৩ মাস পরপর ভেড়াকে কৃমিনাশক প্রয়োগ করতে হবে। আমাদের দেশে ভেড়াকে নিয়মিত শেয়ারিং করা বা পশম কাটা হয় না। তাই শরীরে বড় পশমের কারনে বিভিন্ন ধরনের বহিঃ পরজীবী বাস করে এবং বড় পশমের কারনে বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগ হয়। এজন্য বছরে অন্ততঃ দু’বার ভেড়ার পশম কাটতে হবে এবং গোসল করাতে হবে তাহলে উকুন, আঠালি, টিক ইত্যাদির প্রকোপ কম হবে। নিয়মিত পিপিআর টিকা প্রদান করতে হবে। এছাড়া ভেড়ার বাচ্চাকে কৃমিনাশক খাওয়াতে হবে।
পানি ঃ ভেড়ার পানি গ্রহনের পরিমান কি কারনে কম বেশি হয়। ভেড়া কি পারিমান পানি পান করবে তা ঋতু, গৃহিত খাদ্যের গুণাগুন ও ধরনের উপর নির্ভর করে। যদি কাঁচা ঘাস খায় তাহলে পানি কম খাবে। যদি আবদ্ধ অবস্থায় পালন করা হয় এবং দানাদার ও শুকনা খাদ্য খায় তাহলে বেশি পরিমান পানি পান করবে। আমাদের ছাগল, ভেড়া এবং দেশি মুরগিকে পরিষ্কার, বিশুদ্ধ পানি খাওয়ানোর প্রবনতা খুব কম। এরা নিজেরা অনুসন্ধান করে যেখানে পায় পানি খেয়ে পিপাসা নিরারণ করে। এ কারনে রোগ বালাইয়ে আক্রান্ত হয়। তাই ভেড়াকে পরিষ্কার বিশুদ্ধ পান সরবরাহ করতে হবে।
ভেড়ার প্রজনন ঃ অন্যান্য দলবদ্ধ প্রাণির মতোই ভেড়ার প্রজনন। ভেড়াকে বলা হয় seasonal breeder যদিও কিছু কিছু ভেড়া সারা বছর ধরে প্রজনন হয়। ভেড়ি সাধারণত: ৬-৮ মাসে প্রজনন উপযোগি হয় (reach at sexual maturity) এবং পুরুষ ভেড়া (ram) ৪-৬ সপ্তাহ বয়সে যৌন পরিপক্কতা লাভ করে। তবে জাত ভেদে এই বয়সের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন- ফিনশিপ জাতের ভেড়ি ৩-৪ মাস বয়সে এবং মেরিনো ভেড়ি কোন কোন সময় ১৮-২০ মাস বয়সে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। ভেড়ার ঋতুচক্র ১৭ দিন পর পর আর্বতিত হয়। গর্ভকাল ৫ মাস। ১০-১২ টি ভেড়ির জন্য একটি প্রজননক্ষম পাঠাই যতেষ্ঠ। ভেড়ি উপযুক্ত দৈহিক ওজনপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত পাল দেয়া ঠিক নয়। কম ওজনের ভেড়ি থেকে প্রাপ্ত বাচ্চার মৃত্যুহার বেশি হয় এবং মা ভেড়ি হতে পরবর্তীতে ভালো সার্ভিস পাওয়া যায় না। একটি পাঠাকে ১০০-২০০ বারের বেশি প্রজনন করানো ঠিক নয়। এছাড়া প্রজনন কাজে ব্যবহৃত পাঠার বাড়তি যত্নের প্রয়োজন। প্রজনন ক্ষমতা বাড়াতে প্রতিদিন ১০ গ্রাম করে অঙ্কুরিত ছোলা এবং দৈনিক ৩৫০- ৫০০ গ্রাম দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। এছাড়া যে ভেড়ি উপযুক্ত সময়েও ডাকে আসে না সে ভেড়িকে এবং পাঠাকে এডি৩ই ইনজেকশন প্রদান করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়া অন্তঃপ্রজনন (inbreeding) এড়াতে সময়ে সময়ে নিজের পালের পাঠা বাদ দিয়ে অন্য পাল থেকে পাঠা আনতে হবে।
ভেড়ার বাচ্চার যত্ন ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা ঃ আমাদের দেশে ভেড়ার পরিকল্পিত বাণিজ্যিক খামার নেই বললেই চলে। একেবারে পারিবারিক পর্যায়ে ভেড়া পালন করা হয়। মাঠ পর্যায়ে দেখা গেছে এভাবে ভেড়া পালনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ভেড়ার বাচ্চার অধিক মৃত্যুহার। মৃত্যুর কারন অনুসন্ধানে দেখা গেছে প্রসবকালীন অব্যবস্থাপনা ও পুষ্টিহীনতা প্রধান। তাছাড়া বাচ্চা প্রসবের পর পর মা ভেড়ির সাথে বাচ্চাকেও মাঠে নিয়ে যাওয়া। সারাদিন মা ভেড়ির সাথে মাঠে মাঠে ঘুরার কারনে শারিরীকভাবে দুর্বল বাচ্চাতে প্রচন্ড ধকল পড়ে এবং মারা যায়। তাই বাচ্চা প্রসবের পর ধকল সহ্য করার সামর্থ্য তৈরি না হওয়া পর্যন্ত মা ভেড়ির থেকে কিছুদিন আলাদা করে রাখতে হবে। বাচ্চাকে শাল দুধ খাওয়াতে হবে এবং যেহেতু মা ভেড়ি থেকে প্রয়োজনীয় পরিমান দুধ পাওয়া যায় না সেজন্য দুধের বিকল্প খাওয়াতে হবে। টেবিলে উল্লেখিত খাদ্য প্রদান করা যেতে পারে।
বয়স ও ওজন ভেদে ভেড়ার বাচ্চার (০-২ মাস) প্রয়োজনীয় খাদ্য ঃ
বয়স (সপ্তাহ) | ওজন (কেজি) | দৈনিক খাদ্য সরবরবাহ (গ্রাম) | |||
মায়ের দুধ (সাকলিং/বিকল্প দুধ) | দানাদার খাদ্য | কচি ঘাস, লতাপাতা | ইউ, এম, এস বা প্রক্রিয়াজাত ঘাস | ||
০ | ১.৫ | ২৯০ | – | – | – |
১ | ২. | ৩৬০ | – | – | – |
২ | ২.৪ | ৪১০ | ১০ | সামান্য পরিমান | – |
৩ | ২.৮ | ৬০ | ১০ | সামান্য পরিমান | – |
৪ | ৩.১ | ৫০০ | ১৫ | সামান্য পরিমান | – |
৫ | ৩.৬ | ৫৬০ | ২০ | ১০০ | – |
৬ | ৪. | ৬০০ | ২৫ | ১৫০ | সামান্য পরিমান |
৭ | ৪.৪ | ৬০০ | ৩০ | ১৫০ | সামান্য পরিমান |
৮ | ৪.৭ | ৬০০ | ৩০ | ১৫০ | ২০ |
বিকল্প দুধের উপাদানঃ
উপাদান | পরিমান (%) |
গুড়া দুধ | ৭০ |
চাল, গম বা ভুট্টার আটা (গুড়া) | ২০ |
সয়াবিন তৈল | ৭ |
লবণ | ১.৫ |
ডাই-ক্যালসিয়াম ফসফেট | ১.৫ |
ভিটামিন-মিনারেল প্রিমিক্স | ০.৫ |
মোট | ১০০ |
সাধারনতঃ আমাদের দেশে ভেড়া একসাথে গড়ে ০২ টি করে বাচ্চা দেয় এবং বাচ্চার গড় ওজন ১-১.৫ কেজির মতো হয়। জন্মের পর প্রতিটি বাচ্চার জন্য দেনিক ৩০০ গ্রাম শাল দুধ প্রয়োজন হয় এবং ৪ সপ্তাহ বয়সে ৫০০মিলি দুধ দিতে হয়। কিন্তু বাস্তব অবস্থায় দেখা গেছে যে এদেশের ভেড়া হতে ঐ পরিমান দুধ পাওয়া যায় না। ফলে পুষ্টিহীনতায় জন্ম নেয়া বাচ্চা জন্মের পরেও পুষ্টিহীনতায় ভুগে। ভেড়ার বাচ্চার মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারন এটা। এ কারনে মায়ের দুধের বিকল্প দুধ অথবা গরুর দুধ ফিডার বা নিপলে করে খাওয়াতে হবে। এ ধরনের ব্যবস্থা নিলে ভেড়ার বাচ্চার মৃত্যুহার কমে যাবে।
ভেড়া পালনের উপযোগিতাঃ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভেড়া পালন করা হয় প্রধানত: মাংশ এবং উলের জন্য। আমাদের দেশে কোন উপযোগিতা অনুসরন করে ভেড়া পালন করা হয় না। সমাজের নিরুপায় কর্মহীন কিছু মানুষ জীবন জীবিকার জন্য ভেড়া পালন করে। তবে বিক্রয় করা হয় মাংশের জন্য। অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ডসহ পৃথিবীর কিছু উন্নত দেশে মাংশের চেয়ে উল উৎপাদন ভেড়া পালনের প্রধান উদ্দেশ্য। শোনা যায় কখনো কখনো এসব অনেক দেশের রাজনীতির মুখ্য বিষয় হয়ে যায় উলের দাম ও উৎপাদনের বিষয়টি।
ভেড়ার মাংশের গুনাগুন ঃ
পুষ্টি উপাদন | ভেড়া | গরু | ছাগল |
পানি% | ৭৫ | ৭৪ | ৭৪ |
আমিষ% | ২৩ | ২২ | ২২ |
চর্বি% | ৩ | ৩ | ৩ |
শক্তি | ৫৪৬ | ৪৯৮ | ৪৭৭ |
জিংক (মি.গ্রাম/১০০ গ্রাম) | ৪.৫ | ৪.৫ | ৪.২ |
কপার (মি.গ্রাম/১০০ গ্রাম) | ০.২২ | ০.১২ | ০.০৮ |
ফসফরাস (মি.গ্রাম/১০০ গ্রাম) | ২৯০ | ২১৫ | ২৬০ |
ভিটামিন এ (মি.গ্রাম/১০০ গ্রাম) | ১০ | ২০ | ১০ |
ভিটামিন বি-১ (মি.গ্রাম/১০০ গ্রাম) | ২০০ | ১০০ | ৫৯০ |
ভিটামিন বি-২ (মি.গ্রাম/১০০ গ্রাম) | ২০০ | ২০০ | ২০০ |
ভিটামিন বি-৬ (মি.গ্রাম/১০০ গ্রাম) | ৩০০ | ৪০০ | ৩০০ |
ভিটামিন বি-১২ (মি.গ্রাম/১০০ গ্রাম) | ২.৫ | ২ | ২.৫ |
ভিটামিন সি (মাইক্রোগ্রাম/১০০ গ্রাম) | ১০০০ | ১৫০০ | – |
ভিটামিন ই (মি.গ্রাম/১০০ গ্রাম) | ৫০০ | ৪০০ | ৫০০ |
লোহ (মি.গ্রাম/১০০ গ্রাম) | ২ | ৩ | ২ |
ক্যালসিয়াম (মি.গ্রাম/১০০ গ্রাম) | ১০ | ১০ | ১০ |
সোডিয়াম (মি.গ্রাম/১০০ গ্রাম) | ৮০ | ৪০ | ৭৭ |
টাশিয়াম (মি.গ্রাম/১০০ গ্রাম) | ৪০০ | ৪০০ | ৩০০ |
কোলেষ্টেরল (মি.গ্রাম/১০০ গ্রাম) | ৭০ | ৭৬ | ৭০ |
ভেড়ার মাংশের সাথে গরু ও ছাগলের মাংশের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে পুষ্টিমানের বিচারে ভেড়ার মাংশের সাথে ছাগল ও গরুর মাংশের তেমন কোন পার্থক্য নেই। বরং শক্তি (energy) এবং কোন কোন খনিজ উপাদানের পরিমান ছাগল ও গরুর মাংশের তুলনায় ভেড়ার মাংশে বেশি। তাই ছাগলের মাংশের সাথে স্বনামে ভেড়ার মাংশ আমাদের খাদ্য তালিকায় যোগ হতে পারে।
ভেড়া পালনের সুবিধা ঃ
১) ভেড়া ছোট নিরীহ প্রাণি। এদের খাদ্য খরচ কম, রাখার জন্য অল্প জায়গা দরকার হয় এবং প্রাথমিক বিনিয়োগ কম বলে শুধুমাত্র বসতঃ বাড়ি আছে এমন কৃষক আনায়সে ৫-১০ ভেড়া পালন করতে পারেন। যে কোন প্রাণি প্রতিপালনের চেয়ে ভেড়া পালনে উৎপাদন খরচ কম।
২) ভেড়া সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে পছন্দ করে তাই কেউ যদি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভেড়া পালন করতে চায় সেক্ষেত্রে একজন লোক সহজেই ১০০-১৫০ ভেড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।
৩) ভেড়ার অভিযোজন ক্ষমতা ছাগলের চেয়ে বেশি তাই যেকোন প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাওয়ায়ে চলতে পারে। ভেড়া গরুর পালের সাথে একসাথে পালন করা যায়।
৪) ভেড়া অত্যন্ত নিম্নমানের খাদ্য গ্রহন করে তা উচ্চমূল্যের প্রোটিনে পরিনত করে বলে ভূমিহীন কৃষক, প্রান্তিক চাষী এবং নারী ও কর্মহীন মানুষদের সংসারে বাড়তি আয়ের একটা ভালো যোগান হতে পারে ভেড়া পালন।
৫) ভেড়ার মাংশ তুলনামূলকভাবে নরম, রসালো ও গন্ধহীন এবং মাংশের আঁশ চিকন বলে সহজপাচ্য।
৬) ভেড়া প্রধানত: বছরে ২ বার বাচ্চা প্রদান করে এবং প্রতি প্রসবে অনুন্য ২ টি বাচ্চা দেয় এ কারনে কম সময়ে দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি হয়।
৭) ভেড়ার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।
৮) ভেড়া পালন করে থেকে শুধু মাংশই পাওয়া যায় না, ভেড়া থেকে পাওয়া যায় উন্নতমানের গরম কাপড় তৈরির জন্য পশম এবং চামড়া।
ভেড়ার মাংশ ব্যবহারের প্রতিবন্ধকতা কি ঃ ভেড়ার মাংশ খাওয়াতে তেমন কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। ভেড়ার মাংশের প্রাপ্যতার বিষয়টি’ই হলো আসল বিষয়। ভেড়ার মাংশ সহজ প্রাপ্য হলে মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করবে। আমাদের দেশে ভেড়ার কোন বাণিজ্যিক খামার নেই। যে সকল ভেড়া আমরা দেখতে পায় তা একজন ক্ষুদ্র কৃষক বা খামারীর পারিবারিকভাবে পালিত ভেড়া। এসব ভেড়া বিজ্ঞানভিত্তিক খামার ব্যবস্থাপনার আলোকে পালন করা হয় না। মাঠে ঘাটে বনে-বাদারে ছেড়ে পালন করা হয় বলে ভেড়ার বড় বড় পশমে বিভিন্ন ময়লা আবর্জনা লেগে থাকা অবস্থাটাই আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়।আমরা জানি ছাগল সর্বদা শুকনা স্থানে থাকতে, শুকনা ও পরিষ্কার খাদ্য খেতে পছন্দ করে। এমন কি মেঘ ডাকার শব্দ শুনেই ছাগল শুকনা স্থানে যাওয়ার জন্য চেঁচাতে থাকে। এটা ছাগলের প্রজাতিগত বা বংশগত (genetically) আচরণ বা অভ্যাস যা পরিবর্তনীয় নয়।এ কারনে ছাগলের দেহ পরিষ্কার ও চকচকে থাকে। অপরদিকে ভেড়া বৃষ্টি বাদল, কাদা-পানির মধ্যে চরে খায়। তাছাড়া ভেড়ার পশম বড় ও কোকড়ানো হওয়ার কারনে সহজেই ময়লা লেগে যায়। ভেড়ার মাংশ খাওয়ার সময় ভেড়ার নোংরা শরীর চোখে ভাসে বিধায় অরুচি তৈরি হয়। পারিবারিকভাবে পালন করা হয় এবং পশম বিক্রয়ের তেমন সুযোগ তৈরি না হওয়ায় আমাদের দেশের ভেড়া পালনকারীগন ভেড়ার পশম কাটেন না। যদি বছরে দুই বার ভেড়ার পশম কাটা হয়, সপ্তাহে অন্তত: একবার গোসল করানো হয় এবং ডান্ডি ব্রাশ বা বডি ব্রাশ ব্যবহার করা হয় অর্থাৎ ব্যবস্থাপনা ভালো হয় তাহলে ভেড়ার শরীরও ছাগলের মতো চকচকে দেখাবে। জনশ্রুতি আছে বাজারে ভেড়ার মাংশ ছাগলের মাংশ হিসাবে বিক্রি হয়। পুষ্টিমান এবং স্বাদের বিচারে ভেড়ার মাংশ এবং ছাগলের মাংশে কোন তফাৎ নেই বলে আমরা খাওয়ার সময় বুঝতেও পারি না ছাগলের মাংশ না ভেড়ার মাংশ খাওয়া হলো। তাই আমরা ভেড়ার মাংশ স্বনামে অর্থাৎ ভেড়ার মাংশ হিসাবে খেতে চায়। জমির স্বল্পতা, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা পূরণ, দারিদ্র বিমোচন তথা আত্বকর্মূসংস্থান সৃষ্টিতে গবাদিপশু পালন একটা উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করে আসছে। খুব কম সময়ে পাল বড় হয় বলে দেশের বেকার যুবক-যুবতী, কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি ও দারিদ্র বিমোচনের সহজ হাতিয়ার হতে পারে ভেড়া পালন। ভেড়া পালনে মানুষকে উদ্বুদ্ধকরন দেশি ভেড়ার উন্নয়ন ও সংরক্ষণের জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর হতে পাঁচ বছর মেয়াদি “সমাজভিত্তিক ও বাণিজ্যিক খামারে দেশি ভেড়ার উন্নয়ন ও সংরক্ষণ (২য় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্প চালু রয়েছে। দেশের ৪৮০টি উপজেলা এই প্রকল্পের কার্যক্রমের আওতাভুক্ত।
ভেড়া বিশ্ব কৃষি অর্থনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চীন, অষ্ট্রেলিয়া, ভারত এবং ইরান পৃথিবীর নেতৃত্ব স্থানীয় ভেড়া উৎপাদনকারী দেশ। উল এবং ভেড়ার মাংশের স্থানীয় এবং আর্ন্তজাতিক রপ্তানী বাজারের চাহিদার বড় অংশ এ সব দেশগুলো পূরণ করে। নিউজিল্যান্ডে ভেড়ার সংখ্যা উল্লেখিত দেশগুলোর তুলনায় কম হলেও ভেড়া হতে তৈরি বিভিন্ন (sheep product) পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটা বড় অংশ অর্জন করে থাকে।
সিনথেটিক ফেব্রিক্সের কারনে যদিও বর্তমান সময়ে ভেড়াজাত (sheep product) পণ্যের চাহিদা কিছু কম, তথাপি প্রাণিসম্পদের অন্যান্য উপাদনের তুলনায় একটি সুনিদিষ্ট অর্থনৈতিক সুবিধা রয়েছে। গরু এবং মুরগির বাণিজ্যিক খামারের তুলনায় ভেড়া পালনের জন্য বাসস্থানের জন্য বেশি খরচ হয় না। একটা গরু পালনের জন্য যে পরিমান জায়গার দরকার হয় সে পরিমান জায়গায় ৬ টি ভেড়া পালন করা যায়। অন্যান্য প্রাণি যে সমস্ত ঘাস স্পর্শই করে না এমন ঘাস ভেড়া খায় এমনকি ক্ষতিকর ও বিষাক্ত ঘাসও ভেড়া খায় এবং ভেড়া হতে খুব কম সময়ে অনেক বাচ্চা পাওয়া যায়। ভেড়া পালনে উৎপাদন খরচ অন্যান্য প্রাণি পালনের চেয়ে কম হওয়ায় সমান বিনিয়োগে একজন উৎপাদনকারী বা পালনকারী বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারেনে। তবে পারিবারিক খামারে ভেড়া পালন বেশি লাভজনক।
সহাযতাঃ ১) ভেড়া পালন পুস্তিকা, সমাজভিত্তিক ও বাণিজ্যিক খামারে দেশি ভেড়ার উন্নয়ন ও সংরক্ষণ প্রকল্প (২য় পর্যায়) প্রকল্প।
২) ইন্টারনেট।