স্টেরয়েড কি? অতি সাধারণভাবে বলতে গেলে স্টেরয়েড এক ধরনের হরমোন যা মানুষ সহ সকল স্তন্যপায়ী প্রানীতে তৈরি হয়। এটি একটি প্রাকৃতিক উপাদান ও রাসায়ানিক দৃষ্টিকোণ হতে বলা যায় অর্গানিক উপাদান। রাসায়নিক গঠন ও শারীরবৃত্তীয় কাজের ভিন্নতা অনুযায়ী বহু ধরনের স্টেরয়েড হরমোন আছে। এই হরমোনসমূহ আমাদের শরীরে বিভিন্ন জটিল শারীরবৃত্তীয় ও বিপাকীয় কাজ সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। মোটা দাগে স্টেরয়েড হরমোন ২ প্রকার। এর একটি হলো এনাবলিক-এন্ড্রোজেনিক স্টেরয়েড হরমোন যা সংক্ষেপে এএএস হরমোন নামে পরিচিত। বহু ধরনের এএএস হরমোন রয়েছে যা জটিল চিকিৎসা কাজে ব্যবহার হয়। এদের অপব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক হতে পারে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে ডোপিং এর কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। এএএস ডোপিং এর ফলে বেন জনসন নামের একজন বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ তাঁর অলিম্পিকের সোনা জিতেও হারিয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেসন বা সংক্ষেপে এফডিএ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কর্তৃক এ ধরনের স্টেরয়েড হরমোন ফুড এনিম্যাল বা দুগ্ধ ও মাংস উৎপাদনকারী প্রাণীতে ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটি একটি শিডিউল-৩ কন্ট্রোল সাবস্টেন্স হিসাবে গণ্য। এই হরমোন সংরক্ষণ, বিতরণ ও ব্যবহার অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত এবং এর অপব্যবহার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে এনাবলিক-এন্ড্রোজেনিক স্টেরয়েড গ্রুপেরই একটি সিনথেটিক প্রোডাক্ট “ট্রেনবোলন” যা মাংশ উৎপাদন বা গরু মোটাতাজাকরনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি শুধুমাত্র ভেটেরিনারি চিকিৎসকের প্রেশক্রিপসান ও প্রতক্ষ্য তত্বাবধানে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা হয়। গরু জবাইয়ের সরবোচ্চ দুই মাস পূর্বে সাধারণত ইঞ্জেকশান বা কানের চামড়ার নিচে ইমপ্ল্যান্ট আকারে এটি ব্যবহার করা হয়। এটি একটি জটিল ও ব্যয়বহুল পদ্ধতি। মুখে খাওয়ালে এর কোন কার্যকারিতা নেই বরং লিভার ড্যামেজ হয়ে প্রানীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ট্রেনবোলন মূলত শরীরে নাইট্রোজেনের সংশ্লেষ ঘটিয়ে প্রোটিন তৈরি করে শরীরের মাংসপেশি বৃদ্ধি করে। জানামতে বাংলাদেশ বা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গরু মোটাতাজা করার জন্য ট্রেনবলন ব্যবহার হয় না। বিস্তারিত এখানে আর বলছিনা তবে আর্থসামাজিক অবস্থাই হয়ত এর ব্যবহার ও জনপ্রিয়তার অন্তরায়। এনাবলিক স্টেরয়েড দিয়ে বিফ ফেটেনিং পদ্ধতি বিতর্কিত। তাই যথাযথ কর্তৃপক্ষকে এখন থেকেই এ ব্যপারে সতর্ক হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
আমাদের শরীরে আরেক ধরনের স্টেরয়েড হরমোন তৈরি হয় যা কোরটিকোস্টেরয়েড নামে পরিচিত। কোরটিকোস্টেরয়েড কিডনির উপরে অবস্থিত এড্রেনাল গ্ল্যান্ড হতে তৈরী হয় ও সরাসরি রক্তে মিশে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন বিপাকীয় কাজ সম্পাদন করে। এছাড়াও এটি স্ট্রেস রেসপন্স বা ধকল সামলানো যেমন ধস্তাধস্তি জনিত ধকল বা একস্থান হতে অন্যস্থানে পরিবহন জনিত ধকল প্রতিরোধ, ব্যথানাশক, পানিশূন্যতা রোধ ও পানিশূন্যতা জনিত শক প্রতিরোধ, অনাহার জনিত বিষক্রিয়া যেমন কিটোসিস, ও ক্যান্সারের সহচিকিৎসা ছাড়াও আরো বহুবিধ চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। করটিকোস্টেরয়েডকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে লাইফ সেভিং স্টেরয়েডও বলা হয়। ডেক্সামেথাসন কোরটিকোস্টেরয়েড গ্রুপের একটি সিনথেটিক হরমোন। এটি প্রাকৃতিক হরমোনের চেয়ে প্রায় বিশগুণ শক্তিশালী। ফলে স্বল্পমাত্রায় ব্যবহার বেশ কার্যকরী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক এটি একটি অতীব জরুরি ঔষধ হিসাবে তালিকাভুক্ত । প্রাণী ও জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় এটি নিরাপদ বিধায় ফুড অ্যানিম্যাল অর্থাৎ দুধ ও মাংস উৎপাদনকারী প্রাণীর চিকিৎসার জন্য এটি অহরহ ব্যবহার হয়ে থাকে।
করটিকোস্টেরয়েড গ্রুপের হরমোনের হাফ লাইফ বা অর্ধায়ু অত্যন্ত কম। উদাহরণসরূপ, করটিসোল এক ধরনের করটিকোস্টেরয়েড যার অর্ধায়ু মাত্র ১ ঘণ্টা ৬ মিনিট। অন্যদিকে ডেক্সামেথাসনের অর্ধায়ু প্রায় ৩৬ ঘণ্টা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেসন বা এফডিএ’র নির্দেশনা অনুযায়ী ডেক্সামেথাসনের উইথড্রয়াল পিরিয়ড শূন্য। অর্থাৎ কোন প্রাণীতে ডেক্সামেথাসন ব্যবহার করলে ওই প্রানীর মাংস বা দুধ খাওয়ার জন্য বা বাজারজাত করার জন্য অপেক্ষাকাল শূন্য দিন অর্থাৎ কোন অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। জেনে রাখা ভাল যে গরু জবাইয়ের পূর্ব মুহূর্তেও ধস্তাধস্তির কারণে এড্রেনাল গ্ল্যান্ড হতে প্রচুর পরিমাণে করটিকোস্টেরয়েড নির্গত হয়। নির্গত এসব করটিকোস্টেরয়েড সাথে সাথে রক্তে মিশে যায়। যেহেতু এটি শরীরে কোথাও জমা থাকেনা এবং আমরা রক্ত খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করিনা তাই এতে মানুষের কোন ক্ষতি হয় না।
গরু মোটাতাজাকরনে ডেক্সামেথাসনের কোন ভূমিকা নেই তবে মোটাতাজাকরন কালীন সময়ে মূলত যেসব গরু দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অর্থাৎ সীমান্তের ওপার হতে আসে সেসব গরুতে কিছু মেডিকেল অবস্থার সৃষ্টি হয় বা হতে পারে। প্রাণীস্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা উভয় বিচারে জবাইপূর্ব ঐসব গরুতে ডেক্সামেথাসন ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। ডেক্সামেথাসনের এই ব্যব হার মোটাতাজাকরন সম্পর্কিত নয় এটি চিকিৎসা সম্পর্কিত। ডেক্সামেথাসন একটি প্রেসক্রিপশন ড্রাগ অর্থাৎ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ব্যতীত এর ক্রয়বিক্রয় ও ব্যবহার করা উচিত নয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের ফার্মেসিগুলোতে গিয়ে যে কেউ এটি কিনতে পারেন। ফলে অবৈধ উপায়েও ডেক্সামেথাসন ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে শতকরা কতভাগ কোরবানীর গরুতে এর ব্যবহার হচ্ছে তার কোন পরিসংখ্যান জানা নেই। আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতায় ভারতীয় গরুগুলোতেই এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশী। অর্থাৎ ডেক্সামেথাসন ব্যবহারের শুরুটা সীমান্তের ওপার হতেই শুরু হয়। এই শুরুটা প্রধানত কোরবানীর গরু পরিবহন পরিস্থতির সাথে সম্পর্ক যুক্ত। কিন্তু কিভাবে? আরোও জানতে দেখুন কোরবানীর মোটাতাজা গরু ও স্টেরয়েড নিয়ে গন-আতঙ্ক (৩)।