সংক্রামক রোগ : ক্ষুরারোগ

বাংলাদেশে গরুতে এরোগের ব্যাপকতা অত্যধিক। এখানে সব ঋতুতেই ক্ষুরারোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায় তবে বর্ষার শেষে এরোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। আর সাধারণত শীতকালে এরোগের ব্যাপকতা বাড়ে। সাধারণত গরু, মহিষ, মেষ, ছাগল, শূকুর,হরিণ ও দুই (২) ক্ষুর বিশিষ্ট প্রাণীতে এরোগের মড়ক দেখা দেয়। এছাড়া হাতী ও অন্যান্য বন্য পশুও এরোগে আক্রান্ত হতে পারে। ১৫১৪ খ্রীস্টাব্দে সর্ব প্রথম ইতালী থেকে গবাদিপশুর ক্ষুরারোগ হবার তথ্য পাওয়া যায়। বাতাসের মাধ্যমে এই ভাইরাস এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে প্রায় ৬২ মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। এমনকি সমুদ্র পার হয়ে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে এবং শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। ক্ষুরারোগে মৃত পশুকে খোলা মাঠে ফেলে রাখলে শিয়াল, কুকুর, শকুন ইত্যাদি সবহারী পশু পাখি দ্বারা এ ভাইরাস চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই সব প্রাণির খাদ্য নালীতে এই ভাইরাসের কোন পরিবর্তন হয়না যা পরে বিষ্ঠা ও মল ত্যাগের মাধ্যমে ছড়ায়। মানুষ ও বন্যপ্রাণী থেকে এই ভাইরাস গবাদিপশুতে সংক্রমিত করতে পারে। ১৮৩৪ সালে এই সর্বপ্রথম এই ভাইরাস মানুষে সংক্রমিত হবার তথ্য রয়েছে। রোগাক্রান্ত পশুর ব্যবহৃত দ্রব্যাদি ও পশুজাত দ্রব্যের (চামড়া, মাংস, দুধ ইত্যাদি) মাধ্যমে এ ভাইরাস একস্থান থেকে অন্যস্থানে এমনকি একদেশ থেকে অন্যদেশে ছড়িয়ে পরতে পড়ে। আক্রান্ত গাভীর দুধের মাধ্যমেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। এছাড়া ফ্লাশ পাসচুরায়ন পদ্ধতি ও দুধ পাউডার করার পদ্ধতিও এই ভাইরাসকে নিস্ক্রিয় করতে পারে না। এমনকি বাটার, বাটার ওয়েল, চীজ, ক্যাসিন ইত্যাদি দুধজা খাদ্যদ্রব্যও এই ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। এছাড়া আক্রান্ত ষাঁড়ের সিমেনের মাধ্যমে এই ভাইরাস একদেশ থেকে অন্যদেশে ছড়িয়ে পরতে পারে।


কারণতত্ত্ব
পিকর্নাভাইরিডি (Picornaviridae) গোএভুক্ত এপথ্যভাইরাস (Aphthovirus) জেনাসের অন্তর্গত ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ ভাইরাস (RNA virus) এরোগের কারণ। এই ভাইরাস ইমুনোলজিক্যাল মোট ৭ টি স্ট্রেন রয়েছে।যথা – (A,O,C, SAT-1, SAT-2, SAT-3 এবং Asia-1 )। এসব স্ট্রেনের পরিবর্তনের ধারা অনন্ত। ফলে অবিরত অ্যান্টিজেনিক্যালি নতুন নতুন সাব-টাইপস ( সিরোটাইপস) সৃষ্টি হয়। এই সাব-টাইপস এপর্যন্ত ৬১ টিরও বেশী চিহ্নিত হয়েছে। প্রধানত তিনটি স্ট্রেনের (A, O,C) মধ্যে এর O প্রাদুর্ভাব সর্বাধিক এবং C এর সর্বাপেক্ষা কম। বাংলাদেশে O, Asia-1 এবং C স্ট্রেন চিহ্নিত হয়েছে।ভারতে সনাক্ত করা হয়েছে O,A,C এবং Asia-1 । প্রতিটি স্ট্রেন পরিবর্তনশীল বলে একটি স্ট্রেন অন্য স্ট্রেনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করেনা। এই ভাইরাস ০.৪% বেটা-প্রোপাওল্যাকটন ও ১-২% সোডিয়াম হাইড্রোঅক্সাইড বা ফরমালিন অথবা ৪% সোডিয়াম কার্বনেটে ২ থেকে ১ মিনিটের মধ্যে মারা যায়। গবাধিপশুর কোষের কালচারে এই ভাইরাস বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং সাইটোপ্যাথিক ক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ক্ষুরারোগ বিভক্ত ক্ষুর বিশিষ্ট পশুর একটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে তীব্র প্রকৃতির রোগ । জ্বর, মুখ ও পায়ে ফোস্কা এরোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

রোগের লক্ষণ
০১. প্রাথমিক অবস্থায় জ্বর হয় এবং শরীরের তাপমাএা ১০৭ ͦ ফাঃ পর্যন্ত হতে পারে।
০২. জিহ্বা, দাঁতের মাড়ি, মুখের ভিতর এবং পায়ের ক্ষুরের মাঝখানে ফোস্কা উঠে, পরে ফোস্কা ফেটে লাল ঘায়ের সৃষ্টি করে।
০৩. মুখ দিয়ে লালা ঝরতে থাকে, ঠোঁট নড়া চড়ার ফলে সাদা ফেনা বের হতে থাকে এবং চপচপ শব্দ হয়।
০৪. ক্ষুরের ফোস্কা ফেটে ঘা হয়, পা ফুলে ব্যাথা হয়। অনেক সময় সেখানে পোকা হতে দেখা যায়।
০৫. গাভীর ওলানে ফোস্কা হতে পারে , ফলে ওলান ফুলে উঠে এবং দুধ কমে যায়।
০৬. ছোট বাছুরের ক্ষেএে হৃদপিন্ড (হার্ট) আক্রান্ত হয়, ফলে কোন লক্ষণ ছাড়াই হঠাৎ মারা যায়।

রোগের জটিল অবস্থা
(ক) গর্ভপাত ও পরবর্তীতে গর্ভধারণে অক্ষমতা।
(খ) ওলান, বাঁট ও বাঁটের ছিদ্রে ফোস্কা হবার ফলে ঠুনকো রোগ হবার সম্ভবনা বৃদ্ধি পায়।
(গ) পায়ের ক্ষুর খসে গিয়ে চিরদিনের মত খোঁড়া হবার সম্ভবনা থাকে।
(ঘ) ক্ষতে মাছি ডিম পেড়ে মায়োসিস সৃষ্টি করতে পারে।
(ঙ)গর্ভপাতের ফলে গর্ভফুল সহজে পড়েনা ফলে জরায়ু প্রদাহের সম্ভবনা দেখা দেয়।

আর্থিক ক্ষতিসমূহ
(ক) সাধারণত ক্ষুরারোগে আক্রান্ত শতকরা ২০ টি বাছুর ও ২টি গরুর মৃত্যু ঘটে। অবশ্য তীব্র মড়কের ক্ষেএে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়।
(খ)ক্ষুরারোগে আক্রান্ত গবাদিপশু কৃষি কাজে অক্ষম হয়ে পড়ে, পরিণামে কৃষিকাজ ব্যাহত হয়।
(গ) ক্ষুরারোগ প্রতিরোধ ব্যয়বহুল।ক্ষুরারোগের কারণে গবাদিপশু ও পশুজাত দ্রব্য যেমন – মাংস, দুধ ইত্যাদি আমদানী রপ্তানির সীমাবদ্ধতায় আর্থিক ক্ষতি হয়। খাদ্য হিসেবে এরোগে আক্রান্ত পশুর মাংস ও দুধ নিন্মমানের। এমনকি জনস্বাস্থ্যে এই ভাইরাস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

রোগ নির্ণয়
রোগের ইতিহাস জেনে ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ উপসর্গ (মুখ দিয়ে লালা ঝরা, মুখ ও পায়ে ক্ষত ও খোঁড়ানো ইত্যাদি) দেখে এরোগ নির্ণয় করা যায়। সুনির্দিষ্ট রোগ নিরূপণের জন্য ভাইরাস স্বতন্ত্র ও সনাক্তকরণ প্রয়োজন। আক্রান্ত জিহ্বার এপিথেলিয়াল, কোষযুক্ত রস ও এসোফেজিও-ফ্যারেঞ্জিয়াল ফ্লুইড ৫০% গ্লিসারিনেটেড ফসফেট বাফারে, পিএইচ ৭.৪ অথবা ১% পেপটোন সংগ্রহ করতে হয়। ভাইরাস সংরক্ষণের জন্য পেপটোন অধিক উপযোগী গিনিপিগের পায়ের প্লান্টার প্যাডে আক্রান্ত পশুর সদ্য সংগ্রহীত ফোস্কার রস ত্বকের মধ্যে ইনজেকশন দিলে পজেটিভ ক্ষেএে ১-৭ দিনের মধ্যে ইনজেকশন স্থান এবং তার ১-২ দিন পরে মুখে ফোস্কা সৃষ্টি হবে। কোষ কালচার ও গবেষণাগারের প্রানীতে এই ভাইরাস বৃদ্ধি ও স্বতন্ত্র করা যায়। কমপ্লিমেন্ট ফিকজেশন টেস্ট (CFT) ও ইলাইজা (ELISA) পরীক্ষার মাধ্যমে এই ভাইরাসের স্ট্রেন সনাক্ত করা যায়।

রোগে প্রাণী মারা গেলে করনীয়
কোনো প্রাণী ক্ষুরা রোগে মারা গেলে দূরে একটি গভীর গর্ত খুঁড়ে মৃত প্রানীকে তার মধ্যে রেখে তার ওপর কাঁচা সোডা বা পটাসিয়াম পারম্যাংনেট মিশ্রিত পানি ছিটিয়ে দিয়ে পুঁতে ফেলতে হবে, অথবা মৃত প্রাণীকে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

রোগ নিরন্ত্রন পদ্ধতি
যে সব দেশে ক্ষুরারগের প্রাদুর্ভাব নাই বা নিরন্ত্রিত অবস্থায় রয়েছে সেদেশে দৈবাৎ ক্ষুরারগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে আক্রান্ত পশুকে মেরে ফেলে মাটির নীচে পুঁতে এরোগের মূলোৎপাটন করা হয়। এটিই ক্ষুরারোগ নিরন্ত্রণের সর্বোত্তম পদ্ধতি । তবে ভারত ও বাংলাদেশের ন্যায় দেশে যেখানে এরোগের প্রাদুর্ভাব বেশী এবং মড়ক আকারে প্রায় ঘটে সেসব দেশে এপদ্ধতি প্রয়োগ সম্ভব নয়। বাংলাদেশে ক্ষুরারোগের ব্যাপকতা, বিভিন্ন স্ট্রেন, ভারত থেকে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে পশু আমদানী, টিকার অপর্যাপ্তি ইত্যাদি এরোগ নিরন্ত্রন অত্যন্ত জটিল।

স্বাস্থ্যস্মমত ব্যবস্থা
রোগ যাতে না ছড়ায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে আক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে পৃথক করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আক্রান্ত পশুকে শুকনো স্থানে রাখতে হবে। কোন অবস্থাতেই কাদাজলে রাখা যাবে না। গোয়াল ঘর ও রুগ্ন পশুর ব্যবহৃত দ্রব্যাদি ১-২% সোডিয়াম হাইড্রোঅক্সাইড বা ফরমালডিহাইড অথবা ৪% সোডিয়াম কার্বনেট সলুসান দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। ক্ষুরারোগে মৃত পশুকে ৬ ফুট মাটির নীচে পুঁতে ফেলতে হবে। কোন ক্রমেই খোলা স্থানে ফেলে রাখা সঙ্গত নয়।

চিকিৎসা
সাধারণ ভাইরাস জনিত রোগের কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই নিয়মিত ক্ষুরারগের টিকা প্রদান করতে হবে। তবে রোগাক্রান্ত পশুর সূষ্ঠু পরিচর্যা ও আনুষঙ্গিক বিশেষ ব্যবস্থার সুফল পাওয়া যায়। মৃদু জীবাণুনাশক পদার্থ (০.১%) দ্বারা মুখের ও পায়ের ক্ষত পরিষ্কার করা ভাল। এছাড়া পায়ের ক্ষতে সালফানিলামাইড পাউডার লাগানো যেতে পারে। ক্ষুরারোগে জীবাণুর জটিলতা রোধে অ্যান্টিবায়োটিক অথবা সালফোনেমাইডস ইনজেকশন দিলে সুফল পাওয়া যায়।

সুএঃ
০১. পশু পালন ও চিকিৎসাবিদ্যা – ডঃ এম এ সামাদ ।
০২. Wikipedia : Foot-and-mouth disease (http://en.wikipedia.org/wiki/Foot-and-mouth_disease)
০৩. Blood, D. C. & Radostitis, O. M. (1989). Veterinary Medicine. 7th Edition Bailliere, Tindall, London
০৪. গবাদি পশুর টিকা প্রদান কর্মসূচী নোটবুক , প্রকাশনায়ঃ মৎস্য ও প্রানিসম্পদ অধিদপ্তর, খামার বাড়ি, ঢাকা।
০৫. ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা।

লেখকঃ ডাঃ মোঃ নাহিদ হাসান

DVM, M.S in Pharmacology (BAU) E-mail: nahiddvm788@gmail.com

এটাও দেখতে পারেন

বিভিএ’র নবনির্বাচিত কমিটির বিগত এক মাসের অর্জন

এক মাস পূর্ণ করলো বিভিএ ২০১৭-২০১৮ কমিটি। কেমন ছিলো এই এক মাসের অগ্রযাত্রা ? কী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.