প্রানি খ্যাদ্যে নাইট্রেট ও নাইট্রাইটের বিষ্কক্রিয়া

প্রানির খ্যাদ্যে বিষ্কক্রিয়া সৃষ্টির ক্ষেএে নাইট্রেটও নাইট্রাইটের ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে। খাদ্যে অতিরিক্ত নাইট্রেট ও পাকান্ত্রপ্রদাহ সৃষ্টি করে। তবে মূলত প্রানির নাইট্রাইট বিষ্কক্রিয়া পাকান্ত্রের নাইট্রেট থেকে রুপান্ত্ররিত হয়। অথবা নাইট্রাইট হিসেবেই দেহে প্রবেশের মাধ্যমে বিষ্কক্রিয়ার সৃষ্টি করে। নাইট্রাইট বিষ্কক্রিয়ায় মেথিমোগ্লবিন সৃষ্টি হয়ে অ্যানেমিক অ্যানাক্সিয়া হয় ফলে শ্বাস কষ্ট দেখা দেই।


রোগের কারণ

(ক) খাদ্য:
১. নাইট্রেট সমৃদ্ধ উদ্ভিদ, ঘাস ও খড় ভক্ষণঃ যেসব উদ্ভিদে শুষ্ক পদার্থের কমপক্ষে ১৫% পটাশিয়াম নাইট্রেট থাকে সেগুলো খেলে গবাদিপশুতে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে।

২. নাইট্রেট সমৃদ্ধ রসালো ঘাস থেকে প্রস্তুত সাইলেজ নিংড়ানো পানি পানঃ সাইলেজ প্রস্তুতের সময় উত্তাপ এবং এনজাইমের উপস্থিতিতে নাইট্রেটের পরিমান হ্রাস পায় কিন্তু সাইলেজ নিংড়ানো পানিতে প্রচুর পরিমান নাইট্রেট থাকতে পারে যা পান করলে পশুতে বিষক্রিয়া হতে পারে।

৩. নাইট্রেট সমৃদ্ধ ভূমির নলকূপ বা ডোবার পানি পান করা।
গরুর প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য সোডিয়াম নাইট্রেট ০.৬৫ -০.৭৫ গ্রাম এবং সোডিয়াম নাইট্রাইট ০.১৫ -০.১৭ গ্রাম বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

(খ) ভৌগোলিক কারণঃ

১. ভৌগোলিক বিস্তৃতি : বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহুদেশে গবাদিপশুতে নাইট্রেট/নাইট্রাইট বিষক্রিয়াজনিত রোগ হবার প্রমাণ পাওয়া গেছে। পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে নাইট্রেট সমৃদ্ধ উদ্ভিদ পাওয়া যায় সে সব জায়গায় নাইট্রেট বিষক্রিয়াজনিত রোগসমূহ দেখা যায় এবং গবাদিপশুর মৃত্যু ঘটে।

২. উদ্ভিদের প্রভাব : নাইট্রাইটের বিষক্রিয়া সৃষ্টিতে উদ্ভিদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। প্রতিটি উদ্ভিদের মধ্যে নাইট্রেট থাকে যা থেকে উদ্ভিদ নিজস্ব আমিষ সংশ্লেষণ করে। উদ্ভিদস্থ পটাশিয়াম নাইট্রেট গবাদিপশুর জন্য ক্ষতিকর। যে উদ্ভিদের মধ্যে শুষ্ক পদার্থের অনুপাতে শতকরা মাত্র ১.৫ ভাগ পটাশিয়াম নাইট্রেট থাকে সে সকল উদ্ভিদ ক্ষতিকর। অবশ্য বহু উদ্ভিদের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ পটাশিয়াম নাইট্রেট পাওয়া যেতে পারে।

৩. উদ্ভিদের মধ্যে কতগুলো নির্দিষ্ট প্রকৃতির উদ্ভিদ রয়েছে। নাইট্রেট সার বা গোবর সার ব্যবহৃত ভূমিতে উৎপাদিত শুধু নির্দিষ্ট প্রকৃতির ক্ষতিকর ঘাসই নয়; বরং অনেক নিরাপদ ঘাসের মধ্যে ক্ষতিকর মাত্রায় নাইট্রেট সঞ্চিত হয়ে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। এভাবে উৎপাদিত নেপিয়ার ঘাস খেয়েও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অনেক গবাদিপশু প্রতিবছর মারা যায়।

৪. আবহাওয়ার প্রভাব: দীর্ঘস্থায়ী প্রখর খরা মৌসুমে মাটির উপরিভাগে নাইট্রেট সঞ্চিত হয়। এরপর প্রবল বৃষ্টিপাত হলে নির্দিষ্ট ক্ষতিকর প্রকৃতির উদ্ভিদ ছাড়াও নিরাপদ উদ্ভিদও প্রচুর নাইট্রেট সঞ্চিত করতে পারে। সুতরাং এসময় এ সকল উদ্ভিদ খেয়ে গবাদিপশুতে নাইট্রাইটের বিষক্রিয়া মড়ক হিসেবেও দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশে শামা ঘাস, হেলেঞ্চা ঘাস, ভুট্টা ঘাস দ্বারা এরূপ পরিস্থিতিতে গরুতে নাইট্রাইটের বিষক্রিয়াজনিত মড়ক আরম্ভ হয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত এ সকল ঘাস প্রকৃতিগতভাবেই নাইট্রেট সমৃদ্ধ এবং ক্ষতিকর নাকি বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্ষতিকর হয়ে যায় তা অবশ্য গবেষণায় প্রমাণিত হয়নি। যেসব উদ্ভিদে শুষ্ক পদার্থের পরিমাণ হিসেবে ১.৫% এর বেশি নাইট্রেট পাওয়া যায়, তবে তা ক্ষতিকর হতে পারে। আবার যখন পরিবেশের তাপমাত্রা কমে যায়, তখন উদ্ভিদের মধ্যে নাইট্রেট ভেঙ্গে এমোনিয়া হবার জন্য উপকারি এনজাইম কমে যায়। এসময় দানাদার খাবার বেশি খাওয়ানো হলে গরুর রক্তে ল্যাকটিক এসিডের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে গবাদিপশুর খাদ্যরুচি ও দুধ উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়।

৫. পশুর ক্ষুধা ও খাদ্যগ্রহণের প্রভাব: অভুক্ত পশুর পাকস্থলীর নাইট্রেট নিষ্ক্রিয়করণ ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। এ কারণে অভুক্ত প্রাণী যদি নাইট্রেটসমৃদ্ধ ঘাস খায় তাহলে অধিকহারে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। ধীরে কিন্তু অধিক ঘাস খেলে রুমেনে নাইট্রাইট এমোনিয়া সৃষ্টি করে নিষ্ক্রিয় হওয়ার সময় পায়। একারণে একই খামারে একই সময়ে একই ঘাস খেলেও সকল পশুই বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে দেখা যায় না। এ অবস্থায় নাইট্রেট সমৃদ্ধ ঘাস খাওয়ানোর পাশাপাশি শুকনো খড় খাওয়ানো হলে নাইট্রেটের বিষক্রিয়া হ্রাস পায়।

রোগলক্ষণ

১. নাইট্রেটের বিষক্রিয়া: বিষাক্ত ঘাস খাওয়ার ২-৬ ঘন্টার মধ্যে রোগ প্রকাশ পেতে দেখা যায়। পশুর ডায়রিয়া, ক্ষুধামান্দ্যতা, পেটফাঁপা, লালা পড়া, অস্থিরতা, মুখের মিউকোসা সাদা হয়ে যাওয়া এবং কখনো তীব্র পেটব্যথা পরিলক্ষিত হয়। এসময় যদি পশুকে ওই ঘাস খাওয়া থেকে বিরত রাখা না হয় তাহলে রোগ তীব্রতর হয়ে পশু মারা যেতে পারে। গরু এবং ভেড়া প্রত্যহ যদি নাইট্রেট সমৃদ্ধ খাদ্য স্বল্প পরিমাণে খেতে থাকে তাহলে গর্ভপাত ঘটতে পারে।

২. নাইট্রাইটের রোগলক্ষণ (গরুতে) : রক্ত প্রবাহ এবং শ্বাসক্রিয়া নিষ্ক্রিয় হওয়ায় অনেক পশু হঠাৎ মারা যায় অথবা কাঁপতে কাঁপতে পড়ে গিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যায়। অন্যত্র ঘাস খাওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকে শরীরে কাঁপুনি, অস্থিরতা, শ্বাসকষ্ট, পেটফাঁপা, পেট ব্যথা, বমি, লালা-ঝরা, পেটে লাথি মারা, ইত্যাদি লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। তীব্র শ্বাসকষ্টের কারণে পশু মুখ হাঁ করে এবং জিহ্বা বের করে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করে এবং গোঙায়। শরীরে কাঁপুনি যা ঠোঁট, নাক, চোখের পাতা এবং কানে প্রথমে দেখা যায় ও পরবর্তীতে শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। পশু শীঘ্রই দুর্বল হয়ে পড়ে, হাঁটতে পারে না এবং মাটিতে পড়ে যায়। শায়িত পশুর মাথা ও ঘাড় পার্শ্বে বা পেছনের দিকে বাঁকা হয়ে যেতে পারে এবং দেহে মাঝে মাঝে প্রচন্ড খিঁচুনির সৃষ্টি হতে পারে। পশুর মুখের এবং অন্যান্য অংশের ঝিল্লি পর্দা পরীক্ষা করলে তা সাদা ধবধবে বা নীলাভ দেখা যায়। শরীরের তাপমাত্রা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। হ্রদস্পন্দন দ্রুত এবং ক্ষীণতর লক্ষ্য করা যায়। স্ফীত রুমেন ছিদ্র করলে গ্যাস বের হয় এবং প্রাণী কিছু আরাম অনুভব করে। অনেক পশুর উদরাময় হয় এবং মলের সঙ্গে রক্ত বা শ্লেষ্মা বের হতে পারে। শিরা ছিদ্র করে ওষুধ প্রয়োগের সময় কালো বর্ণের রক্ত বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। অধিকাংশ পশু কয়েক মিনিট থেকে ১২-২৪ ঘন্টার মধ্যে মারা যায়। যেগুলো এর পরেও জীবিত থাকে, তাদের রক্তের মেথহিমোগ্লোবিন ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে যায়, কিন্তু পশুর ফুসফুসে ইমফাইসিমা সৃষ্টি হয়। এ রোগের কারণে পশু তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগে এবং শেষে মারা যেতে পারে। যেগুলো মারা যায় না, সেগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ কৃশকায় অবস্থায় থাকে।

চিকিৎসা

নাইট্রাইটের বিষক্রিয়ায় মিথিলিন ব্লু দ্বারা চিকিৎসা প্রদানের ২-৪ মিনিটের মধ্যে সফলতা অর্জন হয়। প্রাণীর প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১-২ মিলিগ্রাম মিথিলিন ব্লু ওষুধ ১% সলিউশন করে শিরার মধ্যে ইজেকশন দেয়া যায়। প্রয়োজন হলে দ্বিতীয়বারও এ ওষুধ প্রয়োগ করা যায়। গরু এবং ভেড়ায় প্রতি কেজি ওজনের জন্য এ ওষুধ ২০ মিলিগ্রাম করে স্যালাইনের মাধ্যমে শিরাপথে ব্যবহার করা যায়। অন্য পশুর ক্ষেত্রে এ ওষুধ অধিক মাত্রায় ব্যবহার করলে মেথহিমোগ্লোবেনিমিয়া হয়। এ জন্য সে সব ক্ষেত্রে ১-২ মিলিগ্রাম-এর অধিক (প্রতি কেজি ওজন) ব্যবহার করা উচিত নয়। রুমেন ছিদ্র করে অথবা স্টোম্যাক টিউব প্রবেশ করিয়ে রুমেন থেকে গ্যাস বের করে অথবা প্রাণীকে ৫% এসিটিক এসিড অথবা তেঁতুলপানি পান করানো যায়। এগুলো রুমেনের পিএইচকে অম্ল করে এবং এনজাইম উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এগুলো ছাড়া রুমেনের এনজাইম বন্ধের জন্য ওষুধ খাওয়ানো যায়।

নাইট্রেট বিষক্রিয়া থেকে গবাদিপশুকে মুক্ত রাখার জন্য করণীয় বিষয়সমূহ

-গবাদিপশুর জন্য চাষকৃত ঘাষের জমিতে কম পরিমাণ নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করতে হবে।
-গবাদিপশুর জন্য সরবরাহকৃত পানিতে অনেকসময় নাইট্রেটের পরিমাণ বেশি থাকতে পারে। এ ব্যাপারে সর্তক থাকা উচিত।
-শীতকালে রসালো ঘাসের মধ্যে নাইট্রেটের পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য সবুজ ঘাসকে অল্প রোদে শুকিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে।
-গরুর খাবার তৈরির সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন নাইট্রেটের পরিমাণ সেখানে বেশি না হয়ে যায়।
-গর্ভবতী এবং দুগ্ধবতী গাভীর জন্য সবুজ ঘাসের সাথে শুকনো খড় মিশিয়ে দেয়া গেলে ক্ষতির প্রভাব কমে যায়; রুমেনে উপকারী অনুজীবসমূহ নাইট্রেটকে ভেঙ্গে এমোনিয়াতে রূপান্তর করার জন্য যথেষ্ট সময় পায়।
-গবাদিপশুর জন্য সরবরাহকৃত ঘাস খাওয়ানোর পূর্বে সেসব খাদ্যে নাইট্রেটের পরিমাণ জানার জন্য ঘাসের নমুনা ল্যাবে পাঠিয়ে নিশ্চিত হতে হবে।
-প্রয়োজনে অভিজ্ঞ প্রাণিচিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে খাবার তৈরি করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

সুএ-
০১ পশু পালন ও চিকিৎসাবিদ্যা – ডঃ এম এ সামাদ ।
০২ Wikipedia : Nitrate and nitrite Poisoning.

লেখকঃ ডাঃ মোঃ নাহিদ হাসান

DVM, M.S in Pharmacology (BAU) E-mail: nahiddvm788@gmail.com

এটাও দেখতে পারেন

বিভিএ’র নবনির্বাচিত কমিটির বিগত এক মাসের অর্জন

এক মাস পূর্ণ করলো বিভিএ ২০১৭-২০১৮ কমিটি। কেমন ছিলো এই এক মাসের অগ্রযাত্রা ? কী …

একটি মন্তব্য

  1. আসাদুজ্জামান সেতু

    প্রিয় স্যার,
    আসসালামু আলাইকুম।
    ভালো আছেন নিশ্চয়।
    মিথিলিন ব্লু ১% ঔষধটির কোম্পানি নাম জানালে আমার জন্য অনেক উপকার হবে।
    স্যার বাজারে কি নামে আছে জানান প্লিজ।
    ধন্যবাদ।
    আসাদুজ্জামান সেতু
    গাইবান্ধা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.