বাংলাদেশ ও চীনের বিজ্ঞানীরা বিশ্বে সর্বপ্রথম মহিষের পূর্ণ জীবন রহস্য উন্মোচনে সক্ষম হয়েছেন। এ উদঘাটনকে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের অন্যতম বড় সাফল্য হিসেবে দেখছে বিশ্ববাসী। মহিষের জীবন রহস্য উন্মোচন করে বাংলাদেশ গর্বিত বলে উল্লেখ করেছেন সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা।
বাংলাদেশের লাল তীর লাইভস্টক ও গণচীনের বেইজিং জেনাম ইনস্টিটিউটের (বিজিআই) যৌথ উদ্যোগে ‘মহিষের (Bubalus bubalis) পূর্ণ জীবন রহস্য উন্মোচন’ শীর্ষক এ প্রকল্প পরিচালিত হয়।
শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর র্যাডিসন হোটেলের বল রুমে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে চীনের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের এ অভাবনীয় আবিষ্কারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়।
প্রকল্পে জীববিজ্ঞানী, বায়ো-ইনফরমেটিশিয়ান ও তথ্য-প্রযুক্তিবিদদের সমন্বয়ে গঠিত একদল গবেষক মহিষের জেনোম উপাত্ত থেকে জৈবিক উপাদান শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করেছেন। এ গবেষণায় পাওয়া উপাত্তগুলো মহিষের উন্নত ও অধিক উৎপাদনশীল জাত উন্নয়নে সহায়ক হবে।
গবেষক দলটির নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশের লাল তীর লাইভস্টক লিমিটেড ও গণচীনের বিজিআই’র প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরা। ‘de novo sequencing এর সর্বাধুনিক ‘Illumina’s HiSeq’ পদ্ধতিতে এ জীবন রহস্য উন্মোচন করা হয়। এ গবেষণায় পাওয়া জীনের আকার ২ দশমিক ৯৪৬ এন। ‘SOAP denovoc’ পদ্ধতিতে জেনোমগুলো একত্রিত করা হয়। এ গবেষণায় মোট ২১ হাজার ৫৫০টি জিন শনাক্ত করা হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যত উজ্বল। দেশের যে বিজ্ঞানীরা মহিষের পূর্ণ জীবন রহস্য উদঘাটনে ভূমিকা রেখেছেন, তাদের কাছে আমরা সবাই কৃতজ্ঞ। এ আবিষ্কার দেশের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেন, একবিংশ শতাব্দী হচ্ছে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির। এ আবিষ্কার বাংলাদেশের সাফল্যের একটি ইতিহাস হয়ে থাকবে।
লাল তীর ও বিজিআই’র যৌথ আবিষ্কার, মহিষের জিন নকশা উন্মোচন গবেষণা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যের একটি মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন দেশি-বিদেশি গবেষকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োক্যামেস্ট্রি অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের প্রধান হাসিনা খান, বাংলাদেশ জুট জেনোম ন্যাশনাল প্রোগ্রামের প্রধান গবেষক মাকসুদুল আলম, চ্যানেল আইয়ের বার্তা বিভাগের প্রধান শাইখ সিরাজ, বিজিআই’র চেয়ারম্যান জিয়ান ওয়াং, ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. গেনজিয়ান ঝানসহ বিভিন্ন দেশের গবেষকরা তাদের বক্তব্য এবং বার্তায় বলেন, এ আবিষ্কারের জন্যে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে প্রশংসিত হবে।
তারা বলেন, এ আবিষ্কারের ফলে মহিষের আকার এবং ওজন বাড়বে। একই সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো মলিকিউলার ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে দ্রুত প্রজনন হবে। বাড়বে দুধ ও মাংসের পরিমাণ।
বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জুন বলেন, এশিয়ার এ অংশের পরিবেশ ও আবহাওয়া মহিষের জন্য বিশেষ উপযোগী। এ গবেষণায় ভূমিকা রেখেছেন চায়নিজ বিজ্ঞানীরাও। যৌথ সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করলে বড় কিছু করা যায়।
বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স জন এফ ড্যানিলজ বলেন, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের পাশাপাশি বিশ্বে বাংলাদেশকে এখন মহিষের জন্যও চিনবে। বাংলাদেশের এ আবিষ্কার চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন লাল তীর লাইভস্টক লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু ও লাল তীর সিড লিমিটেডের পরিচালক তাবিদ এম আউয়াল।
গবেষণা কাজে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ দলের প্রধান লাইভস্টক গবেষক মনিরুজ্জামান বলেন, মহিষ বাংলাদেশের প্রাণীজ আমিষের একটি বৃহৎ উৎস। দেশের প্রাণীজ আমিষের মূল যোগানদাতাদের মধ্যে মাংস ও দুধের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসে মহিষ পালন থেকে। বাংলাদেশের উপকূলীয় ও নদী বিধৌত অঞ্চলে মহিষ পালন করা হয়। সারা বিশ্বে বিশেষত ভারত ও পাকিস্তানে মহিষ খামারে পালন করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো মহিষ সনাতন পদ্ধতিতে পালন করা হয়।
আমাদের দেশে মহিষের খামার গরুর খামারের তুলনায় বেশি লাভজনক। কারণ গরুর তুলনায় মহিষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। গরুর তুলনায় মহিষের মাংস-দুধও বেশি পুষ্টিকর। মহিষের দুধে স্নেহজাতীয় পদার্থের পরিমাণ প্রায় ৮ শতাংশ, যেখানে গরুর দুধে এর পরিমাণ ১ থেকে ৩ শতাংশ। মহিষের মাংসে তুলনামূলক চর্বিও অনেক কম। এছাড়াও মাথাপিছু মাংস ও দুধ উৎপাদনশীলতায় মহিষ গরু থেকে অধিকতর উৎপাদনশীল।
বিজ্ঞানী ড. মনিরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ মহিষ পালনে এশিয়ায় নবম স্থানে। দেশে মহিষের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। এফএও-এর এক গবেষণায় পাওয়া যায়, বাংলাদেশে দৈনিক মাথাপিছু দুধের চাহিদা ২৫০ গ্রাম। কিন্তু সরবরাহের পরিমাণ মাত্র ৩০ গ্রাম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী দেশে মাথাপিছু মাংস সরবরাহের পরিমাণ বছরে মাত্র ৭ দশমিক ৪৬ কেজি। যেখানে চাহিদা ৮০ কেজি হওয়া দরকার।
মনিরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের ভোলা’র সুবর্ণ চর এবং ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর থেকে গবেষণা উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। মূলত ২০১১ সালের মার্চ মাস থেকে বিজিআই’র সহযোগিতায় এ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
সংবাদটি বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম থেকে নেয়া