সম্প্রতি উত্তরাঞ্চলে আবারও হানা দিয়েছে নিপা ভাইরাস। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজনের মৃত্যু সংবাদ আমরা পেয়েছি, যার মধ্যে রয়েছে ৮ বছরের এক শিশুও। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগেরই মৃত্যু হয়ে থাকে এ রোগের কারনে। নিপা ভাইরাস এতটাই সংক্রামক যে, ২০০৪ সালে ফরিদপুরে এক পরিবারের একজন আক্রান্ত হওয়ার পর ওই পরিবারের চারজনের মৃত্যু হয় এ রোগে। এক রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তার রিকশাচালকও নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হন।
১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার পেনিনসুলায় সর্বপ্রথম নিপা ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। অজ্ঞাত রোগ হিসেবে ২০০১ সালে বাংলাদেশে প্রথম এই ভাইরাসের সংক্রমণ নজরে আসে। তিন বছর পরে ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পরীক্ষার মাধ্যমে একে নিপা ভাইরাস বলে সনাক্ত করা হয়। ২০০১ সালে দেশের উত্তর জনপদের সীমান্ত এলাকায় প্রথমবারের মতো নিপা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যাওয়ার পর এ পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত ১৭৬ জনের মধ্যে ১৩৬ জনেরই মৃত্যু হয়েছে। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত মেহেরপুর, নওগাঁ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, রংপুর, ঢাকা, ঝিনাইদহ, নাটোর ও গাইবান্ধায় মানব দেহে নিপা ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। এত বেশি মৃত্যুর হার থাকা সত্বেও এ রোগটি মোকাবেলায় আমরা দৃশ্যমান ও কার্যকরী কোন পদক্ষেপ কি নিতে পেরেছি? সকলেই জানি রোগটি বাদুর বা শুকর থেকে মানবদেহে আসতে পারে। অর্থাৎ মানবদেহে ছড়ানোর উৎস হলো প্রাণি, কিন্তু প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কি বিষয়টা জানে না? তাদের কি কিছুই করার নেই?
মানুষে রোগ হতে পারে সন্দেহে বাংলাদেশে তা মোকাবেলায় কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যয় করা হচ্ছে হাজার কোটি টাকা, অথচ, যেখানে এতগুলো লোক মারা গেল তার প্রতিরোধের জন্য কি করা হয়েছে? হ্যা, আমরা ইদানিং প্রত্রিকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক একটি সতর্কবার্তা প্রচার করতে দেখছি। কোন কোন প্রত্রিকায় খবর এসেছে, আক্রান্ত এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে, লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে, বাড়ি বাড়ি গিয়েও নাকি সচেতন করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও কেন মৃত্যুর মিছলে যোগ হচ্ছে নতুন সদস্য? সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগের যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তার পাশাপাশি এ খবরও আছে যে, সেসব কাজ খুব অল্পই করা হচ্ছে। অল্প যে তার প্রমান মেলে নতুন করে আক্রান্তের খবরে।
এদিকে যে প্রতিষ্ঠানটি এ রোগ নিয়ে গবেষণা করছে, খোদ সেই জাতীয় রোগতত্ত্ব এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বিরুদ্ধেও এখন সন্দেহের তীর! বলা হচ্ছে, তারা তো জানেই বছরের কোন সেময়ে এ ভাইরাসটি ছড়ায়, তাহলে কেন তারা আগাম কোন ব্যবস্থা নেয়নি? বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) গবেষণাকাজে ব্যবহার করার জন্যেই ব্যবহৃত হচ্ছে এ নিপাহ ভাইরাস। আর এ গবেষণায় রিসার্চ ফিল্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশ, যেখানে নিরীহ মানুষ হচ্ছেন গিনিপিগ।

নিপাহ ভাইরাসকে ‘ক্যাটাগরি সি ক্রিটিকাল বায়োলজিক্যাল এজেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সিডিসি। ‘ক্যাটাগরি সি’ এর অর্থ এটাকে সহজেই প্রাণঘাতী রূপ দেওয়া যায় এবং বিপুল পরিমাণে উৎপাদন করা যায়।
বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে আমরা জেনেছি, দেশের কোথাও নিপাহ ভাইরাসের আউটব্রেক হলে সে এলাকায় বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সিডিস ‘র গবেষক দল বিদেশ থেকে আসেন এবং স্থানীয় আর্ন্তজাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআরবি) গবেষক দলসহ আউটব্রেক এলাকায় যান। আউটব্রেক এলাকায় গিয়ে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করেন। এসব কর্মকাণ্ডের সমন্বয় করে আইইডিসিআর। কিন্তু, টানা ১৩ বছর ধরে দেশে এ ভাইরাসের সংক্রমণ হলেও এ রোগের সংক্রমণ বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে আইইডিসিআর-এর পরিচালক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে।
আমরা এতো কিছু বুঝিনা। আমরা বুঝি মানুষের অধিকার। ভারত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে এ ভাইরাসের আক্রমণে মানুষের মৃত্যু হলেও তারা তা মোকাবেলা করতে পেরেছে। মালয়েশিয়ায় শুকর থেকে এ ভাইরাস ছড়ানোর ফলে সেদেশের সরকার শুকর পালন নিষিদ্ধ করে দেয়। তার ফলে তারা এ ভাইরাস থেকে মুক্ত হতে পেরেছে। আমরা কেবল পারছি না কাঁচা খেজুরের রস পান করা থেকে বিরত রাখতে!
আমরা মনে করি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন, সবাই মিলে এটিকে একটি বৃহৎ জাতীয় সমস্যা বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ও বাস্তবসম্মত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন করার জোর দাবী জানাচ্ছি।

Leave a Reply