“প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকার” এই শিরোনামে একটি লেখা কালের কন্ঠের সম্পাদকীয়তে প্রকাশিত হয়েছে। লেখক : ডা. মো. ফজলুল হক, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান, মেডিসিন, সার্জারি অ্যান্ড অবস্টেট্রিক্স বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।। ভেটসবিডির পাঠকদের জন্য লেখাটি হুবহু তুলে ধরলাম……
“জনমনে ধারণা বিদ্যমান যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকরাই বুদ্ধিজীবী। কারণ তাঁরাই বিশ্বের সব চেয়ে উচু বিদ্যাপীঠের শিক্ষাগুরু। তাঁদের মেধা ও সৃজনশীল চিন্তাভাবনায় একটি জাতি তথা দেশ তথ্যপ্রযুক্তিতে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে সক্ষম। তেমনি তাঁদের পরিকল্পনায় কোনো ত্রুটি হলে দেশ বা জাতির জন্য বয়ে আনবে অপরিমিত দুঃখ-দুর্দশা। প্রাণিসম্পদ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং জিডিপিতে এর অবদান প্রায় ৬ শতাংশ। তা ছাড়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১১ কোটি মানুষ। সদাশয় সরকার এ সেক্টরের উন্নতির জন্য সচেষ্ট হলেও অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে সফল হয়নি। এর মূল কারণ হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদ ভেঙে দুটি অনুষদের জন্ম, যা প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের মূল প্রতিবন্ধক। প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে একই অধিদপ্তরে বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত ভেটেরিনারি এবং পশুপালন (অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি) গ্র্যাজুয়েটরা একে অপরের চির প্রতিপক্ষ, যা প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে বাধার মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ বছর ধরে। উল্লেখ্য, ভেটেরিনারি অনুষদ থেকে ডিভিএম (ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন) ডিগ্রিধারীরা রোগের চিকিৎসা, রোগ দমন, গবেষণা, বাসস্থান ব্যবস্থাপনা এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে সক্ষম। কিন্তু পশুপালন গ্র্যাজুয়েটদের ক্ষেত্রে এই সুযোগ না থাকায় একজন কৃষক বা প্রাণী পালনকারী কৃষক বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিএসসি (এএইচ) নামকরণের ডিগ্রিটি প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের মানদণ্ডে অকার্যকর বিধায় ১৯৫৮ সালে বিশ্বের সব ভেটেরিনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে চিরতরে বন্ধ করার সুপারিশ করা হলেও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) এখনো বন্ধ করা হয়নি। ভেটেরিনারি অনুষদটির বয়স এক বছর পার হতে না হতেই ১৯৬২ সালে ভেটেরিনারি সায়েন্সের ২০-২৫ শতাংশ প্রাণী উৎপাদনবিষয়ক এবং অবশিষ্ট ৬৮-৭০ শতাংশ প্রাণী চিকিৎসাবিষয়ক কোর্স কারিকুলাম ও সিলেবাস নিয়ে ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, একটি ভেটেরিনারি পেশায় দুটি ডিগ্রি (ডিভিএম, বিএসসিএএইচ) প্রদানের ব্যাপারে ভেটেরিনারিয়ানরা দুই ভাগে বিভক্ত ছিলেন। বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ দুজন ভেটেরিনারিয়ান প্রশাসনিক ক্ষমতার আকর্ষণে ভেটেরিনারি শিক্ষাব্যবস্থাকে বিভাজিত করে দুটি অনুষদের জন্ম দেন এবং দুজনেই ডিন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। একটি ভেটেরিনারি পেশার শিক্ষা, গবেষণা, প্রশাসন ও মাঠপর্যায়ের কর্মক্ষেত্রে দুটি প্রতিপক্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে শুধু দ্বন্দ্বই সৃষ্টি করা হয়নি; সংশ্লিষ্ট শিক্ষা, গবেষণা ও কর্মক্ষেত্রকে কলুষিত করে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ভেটেরিনারি পেশাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে দুটি অনুষদ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। মেডিক্যাল এবং ভেটেরিনারি পেশার মূল বিষয়টি দিয়ে উদ্দেশ্যটি পরিষ্কার করা যায়। যেমন_মানুষের যে ডাক্তার রোগীর চিকিৎসা করেন, সেই ডাক্তারই ওই রোগীর খাদ্য সম্বন্ধে বলে দেন। আবার যে ডাক্তার পরিবার পরিকল্পনায় নিয়োজিত, তিনি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিসহ চিকিৎসা ও খাদ্যব্যবস্থাসহ প্রেসক্রিপশন দিয়ে থাকেন। বিশ্বের সব দেশে ভেটেরিনারি মেডিক্যাল ডাক্তাররা একইভাবে কার্য সম্পাদন করে থাকেন। অর্থাৎ ভেটেরিনারি ডাক্তাররাই প্রাণীর উৎপাদন এবং স্বাস্থ্যের ওপর কাজ করেন। কিন্তু এই নিয়মের ব্যতিক্রম একমাত্র বাংলাদেশে। কারণ পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই একটি ভেটেরিনারি বা প্রাণিসম্পদ পেশায় দুই ধরনের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা হয়। বাকৃবি ছাড়া অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি নামে বিশ্বের অন্য কোথাও কোনো অনুষদ নেই বা স্নাতক পর্যায়ে এ বিষয়ের ওপর কোনো ডিগ্রিও দেওয়া হয় না। তবে বিভিন্ন দেশে ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদের আওতায় একটি বিষয় হিসেবে অ্যানিম্যাল সায়েন্স পড়ানো হয়। অন্যদিকে মাস্টার্স ও পিএইচডিতে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ তৈরির লক্ষ্যে অ্যানিম্যাল সায়েন্সের ওপর বিশেষ ডিগ্রির ব্যবস্থা রয়েছে।
ভেটেরিনারি সায়েন্স আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পেশা, যাতে পশুপাখি ও বন্য প্রাণীর রোগের চিকিৎসা, রোগের প্রতিরোধ এবং বাসস্থান নির্বাচনসহ উৎপাদন বিষয়ে বিস্তারিত কোর্স কারিকুলাম ও সিলেবাস পড়ানো হয় এবং বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিলের রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত হয়ে প্রাণীর চিকিৎসাসহ যাবতীয় কাজের অনুমতি নিয়েই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হয়। বাংলাদেশ সরকার পশুসম্পদ অধিদপ্তরের প্রশাসন ও মাঠপর্যায়ে দুই ধরনের গ্র্যাজুয়েট নিয়োগ ও কর্মক্ষেত্রে জটিলতার কারণে বাকৃবির প্রশাসনকে পরপর দুবার ভেটেরিনারি সায়েন্স এবং এএইচ অনুষদ দুটিকে একত্রিত করে আগের মতো একটি পূর্ণাঙ্গ ডিগ্রি প্রদানের জন্য বাকৃবিকে দুটি অফিস স্মারক পাঠিয়েও ব্যর্থ হয়। বিশ্বস্ত সূত্রে প্রাপ্ত তৎকালীন পাকিস্তানের একজন প্রথিতযশা প্রাণিসম্পদ বিজ্ঞানী বলেন, একটি দেশে দুটি অনুষদ অযৌক্তিক। এ সমস্যাগুলো দূরীকরণের জন্য বিগত সরকার আমলেও চেষ্টা চালানো হয়, যেমন_১৯৬৯ সালে শিক্ষা সম্পর্কিত মূল্যায়ন কমিটি, ১৯৭৪ সালে তৎকালীন মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রী, ১৯৭৬ সালে পশুসম্পদ অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিচালক ড. আলাউদ্দিন আহম্মেদ, ১৯৭৭ সালে সিএমএলএ, ১৯৮২ সালে ব্রিগেডিয়ার এনাম কমিটি, ১৯৯৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশনসহ বিগত সব সরকারই এএইচ অনুষদটি অকার্যকর বিধায় বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ভেটেরিনারি মেডিসিন নামেই কোর্স রয়েছে। তা ছাড়া জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, এডিবি, বিশ্বব্যাংক, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন প্রাণিসম্পদ শিক্ষায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভেটেরিনারি কোর্স নামে দেশে একটি মাত্র কোর্স রেখে অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি অনুষদ (বাকৃবি) বন্ধের সুপারিশ করে; কিন্তু অদ্যাবধি তা কার্যকর হয়নি।
প্রাণিসম্পদের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৬, ১৯৯৭, ২০০২ ও ২০০৩ সালে দেশে চারটি সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ (চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল ও দিনাজপুর) প্রকল্প গ্রহণ করে। বর্তমানে ঝিনাইদহেও একটি সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ স্থাপন করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য, পূর্ণাঙ্গ কোর্স কারিকুলাম ও সিলেবাসসহ ডিভিএম ডিগ্রি প্রদানের মাধ্যমে জনসাধারণকে সেবা দেওয়া। কলেজগুলোর প্রকল্প মেয়াদ শেষে স্বতন্ত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষদ হিসেবে অধিগ্রহণের আগেই বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগের জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে বাকৃবির অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি অনুষদের আওয়ামী লীগ সমর্থিত একজন সম্মানিত সদস্য থাকায় তাঁর অনুষদের দুজন গ্র্যাজুয়েটকে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগের সুযোগ করে দেন। তাঁদের প্রথম দায়িত্বই ছিল অনুষদের নাম ভেটেরিনারি মেডিসিন পরিবর্তন করে ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স অথবা অ্যানিম্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন নামে অনুষদের নামকরণ করা। এটি একটি ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ, যা অতীতের সেই ভুল সিদ্ধান্তের পুনরাবৃত্তি। উল্লেখ্য, বর্তমানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহেব একজন অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি গ্র্যাজুয়েট হওয়ায় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অর্গানোগ্রাম তৈরি করে এএইচ গ্র্যাজুয়েটদের অপ্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি করে দেশের জনসাধারণের কতটা স্বার্থ সংরক্ষিত হবে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিএলআরআইয়ের অর্গানোগ্রামে মোট ১৭টি বিভাগের মধ্যে একটি ভেটেরিনারি গ্র্যাজুয়েটদের জন্য, অবশিষ্ট ১৬টি বিভাগে এএইচ ডিগ্রিধারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে গবেষণার নামে অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে। বিএলআরআই-এ গবেষণার নামে অর্থের অপচয় হচ্ছে বলে বিশেষ মহল মনে করছে। অন্যদিকে স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও আমরা এ সেক্টরে আশানুরূপ উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ, এর একটি কারণ_কিছু লোকের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। প্রাণিসম্পদের উন্নয়নকে গতিশীল করতে এ মুহূর্তেই বাকৃবির এএইচ অনুষদটি বন্ধ করে ভেটেরিনারি সায়েন্স অনুষদের সঙ্গে পুনরেকত্রীকরণ করা এবং প্রতিটি উপজেলায় চারটি এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে দুটি ভেটেরিনারি সার্জনসহ প্রয়োজনীয় পদ জরুরি ভিত্তিতে সৃষ্টি একান্ত প্রয়োজন।”
- স্যারকে অনেক ধন্যবাদ, এতো তথ্যবহুল আর সময়পোযোগী একটা লেখার জন্য।
- তবে আমার মনে হয় পটুয়াখালী বিঃ ও প্রঃ বিশ্ববিদ্যালয়েও অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি বন্ধ করা উচিত।
- সবশেষে সকল পাঠককে অনুরোধ করছি এই লেখাটা যত বেশি সম্ভব প্রচার করার জন্য
Very good article for our sector….everybody should write on this issue….
Shame less vets….Shame less vets….
Shame less vets….Shame less vets….
Just real need for livestock sector,that is
DVM
thankyou. you are a nice commandants.