অর্গানিক পদ্ধতিতে মুরগি পালন করে সফল সাতকানিয়ার ফখরুল

অর্গানিক পদ্ধতিতে মুরগি পালন করে ব্যাপক সাফল্য পাওয়া সাতকানিয়ার যুবক ফখরুল এখন স্বপ্ন দেখেন, অচিরেই তার অর্গানিক ডিম ও মুরগি ছড়িয়ে পড়বে দেশের আনাচে-কানাচে, সবার ঘরে ঘরে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ঠাঁই করে নেবে তার স্বপ্ন। আর এটি সফল করতে নিরন্তর পরিশ্রম ও গবেষণা করে যাচ্ছেন এই সফল খামারি।


১১ বছর আগে শুরু করা সাতকানিয়ার মাদার্শা গ্রামে নিজের বাড়িতে ফখরুলের অর্গানিক পদ্ধতিতে মুরগি পালন এখন তাকে লাভ দিতে শুরু করেছে। ওই গ্রাম ছাড়িয়ে তাই এটি আলোড়ন তুলেছে চট্টগ্রামের সর্বত্র। তার এ কাজ শুরুর দিনগুলোতে যারা এ নিয়ে সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ ও হাসাহাসি করেছিলেন, তারাও এখন ফখরুলের পদ্ধতিতে মুরগি পালনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

সরেজমিনে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি হ্যাচারি ও পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন ফখরুল ইসলাম সিকদার। মাথায় কি ভুত চাপলো, হঠাৎ একদিন চাকরি ছেড়ে দিয়ে সাতকানিয়ার মাদার্শায় গ্রামে চলে যান ফখরুল। শুরু করেন অর্গানিক পদ্ধতিতে মুরগি পোষা। খাবার দেন হলুদ, আমলকি, ফল-ফলাদি, ঔষধি। নাম দেন, অর্গানিক পদ্ধতিতে মুরগি চাষ।

পাড়ার লোক, দশ গ্রামের মানুষ তার কাণ্ড দেখে হেসেই খুন! কি তাজ্জব! মুরগির খাবার নাকি আমলকি! কিন্তু দমবার পাত্র নন ফখরুল। দীর্ঘ সময়ের নিরন্তর সাধনার পর ২০১১ সালে ফখরুল যখন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তার ব্যবসার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে আসলেন, তখন সাংবাদিকদেরও চক্ষু চড়কগাছ। হাসতে হাসতে দম ফেটে যাওয়ার উপক্রম।

এর পরের ইতিহাস শুধুই এগিয়ে যাবার, শুধুই সেই পাগলাটে স্বভাবের ফখরুলের সাফল্যের। তার হলুদ, আমলকি খাওয়া মুরগির অর্গানিক ডিম এখন চট্টগ্রামের খুলশিমার্ট, মীনাবাজার, স্বপ্ন, কেয়ারফোর এবং নাইন-ইলেভেনের মত সুপার স্টোরগুলোতে বিক্রির জন্য রাখা অন্যতম পণ্য।

সাফল্যের পেছনের গল্প জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন ফখরুল। বলেন, ‘‘যে কোনো নতুন কিছু করতে গেলে মানুষ একটু আশ্চর্য্য হবেই। সবাই সহযোগিতার হাত নাও বাড়াতে পারেন। কিন্তু তাতে দমে গেলে চলবে না। লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে যেতে পারলে সাফল্য আসবেই।’’

সম্প্রতি বাংলানিউজের চট্টগ্রাম কার্যালয়ে কথা হয় ফখরুল ইসলাম সিকদারের সঙ্গে। খোলামেলাভাবে অর্গানিক পদ্ধতিতে মুরগি পালন, ডিমের উৎপাদনসহ সব কথা তুলে ধরেন বাংলানিউজের কাছে।

১৯৯৩ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র ছিলেন ফখরুল ইসলাম সিকদার। এর অনেক আগেই বাবাকে হারান। লেখাপড়ার পাশাপাশি তাকে কখনো জমিতে লাঙল চালাতে হয়েছে, আবার কখনো মাঠে গরু চড়াতে হয়েছে। মুরগি পোষার শখও তখন থেকেই। স্নাতক পড়ার সময়ই নিজের বাড়ির রান্নাঘরে একশ’ মুরগি নিয়ে ছোট একটি ফার্ম গড়ে তুলেন।

১৯৯৫ সালের দিকে এম এম আগা লিমিটেডে মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে চাকরি নিলেন ফখরুল। কিছুদিন পর দেখতে পান, তাদের হ্যাচারিতে ‘গাম্বারো’ নামে এক ধরনের বিশেষ রোগে শুধু মুরগি মারা যাচ্ছে। মুরগি বাঁচাতে তার মালিক ভারত থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়ে আসেন। দেখতে পান, বিশেষজ্ঞ হলে কি হবে, তারা মুরগিকে দিচ্ছেন হোমিও এবং হারবাল চিকিৎসা।

মাথা ঘুরে যায় ফখরুলের। ইন্টারনেট ঘেঁটে, বইপত্র পড়ে রীতিমত গবেষণা শুরু করে দেন ফখরুল। মাথায় চিন্তা ঘোরে হলুদ, আমলকি আর অসুস্থ মুরগির চিকিৎসা। ভাবতে থাকেন, দেশি মুরগিকে তথাকথিত উন্নতমানের পোল্ট্রি ফিড না দেওয়ার পরও সেগুলো এতো সুস্থ সবল কিভাবে থাকে? ফখরুল পরামর্শ করেন কয়েকজন হোমিও চিকিৎসকের সঙ্গেও।

সবার সঙ্গে কথা বলে একদিন চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে গিয়ে মুরগি পোষা শুরু করে দেন। সেই মুরগির খাবারের তালিকায় নেই পোল্ট্রি ফিড, অসুখ হলে চিকিৎসা হার্বাল আর হোমিও পদ্ধতিতে। কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে পকেটের অবস্থা খারাপ। সংসার চালাতে আর মুলধন যোগাতে চাকুরি নেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। পাশাপাশি চলতে থাকে ভেষজ পদ্ধতি মেনে মুরগি পোষার সাধনা।

অবশেষে ২০০০ সালে ফখরুলের সাধনা তার স্বপ্নের পথে যাত্রা শুরু করে। সাতকানিয়ার মাদার্শা গ্রামে শুরু হয় ফখরুলের রহমানিয়া অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যানারে বাণিজ্যিকভাবে ডিম উৎপান কার্যক্রম। এরও ১১ বছর পর যাত্রাপথের সব বিপত্তি এড়িয়ে ২০১১ সালের ১১ মার্চ চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে ফখরুল জানান দেন, তিনি আর পিছিয়ে নেই।

ফখরুল বাংলানিউজকে জানান, বর্তমানে মাদার্শায় এক একর জায়গার ওপর ৪টি শেডে তিনি দু’হাজার মুরগি পালন করছেন। আরও তিন হাজার মুরগির শেড নির্মাণের কাজ চলছে। এসব মুরগি প্রতিদিন ডিম দিচ্ছে প্রায় এক হাজার ৪০০টি করে।

তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে সপ্তাহে তিনদিন চট্টগ্রাম নগরীতে ডিম সরবরাহ করা হয়। একশ’ মুরগি নিয়ে পথচলা শুরু করে তার ফার্মের মূলধন এখন প্রায় অর্ধকোটি টাকা।

ফখরুল বলেন, বর্তমানে বাজারে যেসব ডিম ও মুরগি পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোতে ক্যালরি, প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলের ঘাটতি আছে। এসব মুরগি ও ডিমে আছে হরমোন, এন্টিবায়োটিক, টক্সিন ও পেস্টিসাইড। এসব ক্ষতিকর পদার্থ ফুডচেইনে প্রবেশ করে মানবদেহে অন্ধত্ব, পঙ্গুত্ব সহ বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে।

তার দাবি, কৃত্রিম প্রোটিন ছাড়া ফুলফ্যাট সয়ামিলের সঙ্গে হার্বাল পণ্য নাইজেলা, হলুদ ও আমলকি যুক্ত করে তৈরি খাদ্য পরিবেশনের কারণে তার মুরগি এবং ডিমে রোগ-বালাইয়ের কোনো ঝুঁকি নেই। খেতে প্রচলিত ফার্মের মুরগির চেয়েও সুস্বাদু।

ফখরুল প্রতি কেজি অর্গানিক মুরগি বিক্রি করেন দেড়শ’ টাকায়, ডিমের জোড়া ১৮ টাকা। ফখরুলের অর্গানিক ডিম ও মুরগি চট্টগ্রামের অভিজাত নামী-দামি সুপারস্টোর ছাড়াও এখন শোভা পাচ্ছে দেশের সচেতন সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাসার রান্নার তালিকায়ও।

ফখরুল বাংলানিউজকে জানান, মুরগি এবং ডিমকে কোলেস্টেরলমুক্ত করার নতুন এক গবেষণা তিনি শুরু করেছেন। অচিরেই এতেও সাফল্য আসবে বলে আশা ফখরুলের।

তার স্বপ্ন, অচিরেই তার অর্গানিক ডিম, মুরগি ছড়িয়ে পড়বে দেশের আনাচে-কানাচে সবার ঘরে ঘরে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ঠাঁই করে নেবে ফখরুলের ‘স্বপ্ন’।

সূত্র: বাংলা নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

লেখকঃ হৃদ রহমান

এটাও দেখতে পারেন

প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে অনলাইন গবাদি পশু শনাক্তকরণ এবং নিবন্ধন ব্যবস্থা চালুঃ জানা যাবে স্বাস্থ্য ও রোগের ইতিহাস

প্রাথমিকভাবে ৫০,০০০ পশু নিবন্ধিত হবে যা গ্রাহকদের পশুগুলোর স্বাস্থ্য ইতিহাস দেখার সুযোগ দিবে। প্রথমবারের মতো, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.