‘বাংলা শকুন’ অতিবিপন্ন এক প্রাণী এবং ডাইক্লোফেনাকের প্রভাব

শকুন এক প্রকার পাখি। এটি মৃত প্রাণীর মাংস খেয়ে থাকে। সাধারণত এরা অসুস্থ ও মৃতপ্রায় প্রাণীর চারিদিকে উড়তে থাকে এবং প্রাণীটির মরার জন্য অপেক্ষা করে। পাখিগুলো তীক্ষ দৃষ্টির শিকারি পাখি।


সারা বিশ্বে প্রায় ১৮ প্রজাতির শকুন দেখা যায়, এর মধ্যে পশ্চিম গোলার্ধে ৭ প্রজাতির এবং পূর্ব গোলার্ধে (ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া) ঈগলের সাথে সম্পর্কিত ১১ প্রজাতির শকুন দেখা যায়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশে প্রায ৬ প্রজাতির শকুন রয়েছে, এর মধ্যে ৪ প্রজাতি স্থায়ী আর ২ প্রজাতি পরিযায়ী। শকুন বা বাংলা শকুন ছাড়াও এতে আছে রাজ শকুন, গ্রীফন শকুন বা ইউরেশীয় শকুন, হিমালয়ী শকুন, সরুঠোঁট শকুন, কালা শকুন ও ধলা শকুন। তবে শুধু গ্রীফন প্রজাতির শকুনই মাঝে মাঝে দেখা যায় (পরিপ্রেক্ষিত ২০১০)।

শকুন পশুপাখির মধ্যে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম সদস্য। প্রকৃতির ঝাড়ুদার বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। শকুন মরা গবাদিপশু খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি রোগ জীবাণুর বিস্তৃতি রোধেও সহায়তা করে। প্রশ্ন উঠতে পারে কুকুর, শেয়াল বা বেড়াল গোত্রের প্রাণীরাও মড়াখেকো। তবে কেন শকুন সংরক্ষণ প্রয়োজন। অ্যানথ্রাক্স ব্যকটেরিয়া, খুরা রোগ, গবাদি পশুর যক্ষা, হগ কলেরার জীবাণু খুব সহজেই হজম করতে পারে শকুন। যেটা কুকুর, শেয়াল বা বিড়াল গোত্রের প্রাণীরা হজম করতে পারে না, বরং ছড়িয়ে বেড়ায়। ড. মো. আলী রেজা খান ’৮০র দশকেই সাবধান বাণী শুনিয়েছিলেন যে, শকুনের এই ক্রমহ্রাসমান অবস্থার জন্য বিভিন্ন রোগ জীবানু সহজেই ছড়িয়ে পড়বে। এখনকার মানবদেহে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণের ঘটনা তার প্রমাণ দিচ্ছে।

শকুনের বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ গবাদিপশুর জন্য ব্যবহৃত ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের ব্যবহার। এ দু’টো ওষুধের প্রভাব মৃত গবাদিপশুর দেহেও থাকে। এ ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে এমন কোন মৃতদেহ শকুনের খাদ্য তালিকায় চলে এলে শকুনের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কেননা এর পার্শপ্রতিক্রিয়ায় শকুনের কিডনি নষ্ট করে দেয়।  আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু ঘটে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মাত্র ০.২২ মিলিগ্রাম ডাইক্লোফেনাক যথেষ্ট একটি শকুনের মৃতর জন্য। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, গরুর ব্যথানাশক হিসেবে ডাইক্লোফেনাকের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে শকুনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে আসে। এক দশক আগেও দেশে কয়েক হাজার বাংলা শকুন ছিল। ১৯৮০’র দশকে সার্কভুক্ত দেশে প্রায় ৪,০০,০০,০০০ শকুনের অস্তিত্ব ছিলো, অথচ এই সংখ্যা এখন কমে মাত্র ৪০,০০০-এ এসে দাঁড়িয়েছে।

পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞদের ব্যাপক উদ্বেগ ও প্রচারণার পর বাংলাদেশে ২০১০ সালে ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হলেও সরকারি উদ্যোগ কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কোনো কোম্পানি এই ওষুধ বিক্রি বন্ধ করেছে কি না তা দেখভালের দায়িত্ব কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়নি।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বেশির ভাগ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এখনো ডাইক্লোফেনাক উৎপাদন ও বাজারজাত করে যাচ্ছে।সরকার প্রজ্ঞাপন জারির বাইরে এ পর্যন্ত এর উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
এই মানবসৃষ্ট কারণে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে পৃথিবীর অনেক দেশেই পশু-চিকিৎসায় ‘ডাইক্লোফেন’-এর পরিবর্তে সমান কার্যকর, অথচ শকুন-বান্ধব ‘মেলোক্সিক্যাম’ নামক ঔষধ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

এটাকে মূল অনুঘটক হিসেবে চিহ্রিত করা হলেও পাশাপাশি আরো কিছু ব্যাপারকে উল্লেখ করেছে আইইউসিএন-এর সহযোগী সংগঠন বার্ডসলিস্ট অর্গানাইজেশন। তারা কীটনাশক ও সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির দূষণ, খাদ্য সঙ্কট, কবিরাজি ওষুধ তৈরিতে শকুনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার, বিমান-ট্রেনের সাথে সংঘর্ষ, ঘুড়ির সূতার সাথে জড়িয়ে পড়া, ইউরিক এসিডের প্রভাবে বিভিন্ন রোগ, বাসস্থানের অভাব প্রভৃতি। শকুনের বাসা বাঁধার স্থানের অভাবের জন্য তাদের বংশবৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। পাখি বিজ্ঞানীদের মতে এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী পাঁচ বছরেই হারিয়ে যাবে শকুন।

সারা বিশ্বে, শকুনকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস পালিত হয়ে থাকে।

প্রতিবেদন তৈরি

মোঃ সাজ্জাদ হোসেন (সোহাগ)

ভাইস-প্রেসিডেন্ট, ভেটেরিনারি ছাত্র সমিতি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী

লেখকঃ মোঃ সাজ্জাদ হোসেন (সোহাগ)

মোঃ সাজ্জাদ হোসেন (সোহাগ), ভাইস-প্রেসিডেন্ট, ভেটেরিনারি ছাত্র সমিতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী

এটাও দেখতে পারেন

esta tienda online 1

Las 33 Mejores Tiendas Online En Las Que Comprar Como la mayoría, nos permite devoluciones …

একটি মন্তব্য

  1. আসলে এখন মানুষই শকুন হয়ে গিয়েছে… তাই পাখি শকুন প্রায় বিলুপ্ত…

    সুন্দর প্রতিবেদন। শকুন সচেতনতা দিবস উপলক্ষে আপনাদের বিভাগ থেকে কোনও আয়োজন করা হয়েছে কি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.