চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে পশ্চিম পটিয়ায় সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই ব্যক্তি-উদ্যোগে গড়ে উঠেছে পাঁচ শতাধিক ডেইরি ফার্ম। এসব ডেইরি ফার্মে দুগ্ধ প্রদানকারী গাভী রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার। দৈনিক দুধ উত্পাদিত হচ্ছে প্রায় ৫০ হাজার লিটার। গাভী পালন করে চট্টগ্রামের পটিয়ার ৫ শতাধিক পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে। তাদের দেখাদেখি আশপাশের অন্যরাও গাভী পালনে ঝুঁকেছেন। তবে খাদ্য সঙ্কট, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকা এবং বিভিন্ন কারণে খামারিদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। সরেজমিনে পরিদর্শন করে এসব চিত্র দেখা গেছে।
খামারিরা জানান, শুরুতে দু-তিনটি গাভী দিয়ে বেকার যুবকরা ডেইরি ফার্ম গড়ে তোলেন। বর্তমানে ওইসব ডেইরি ফার্মে গাভীর সংখ্যা বেড়ে ১০০ থেকে ১৫০টি দাঁড়িয়েছে। পটিয়া উপজেলার ২২ ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে পাঁচটিতে প্রায় সব বাড়িতে খামার গড়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক অনুকূল পরিবেশ থাকায় একজনের দেখাদেখি অন্যরা উদ্বুদ্ধ হয়ে একের পর এক খামার গড়ে তুলছেন। তারা জানান, বিগত বিএনপি সরকারের আমলে কিছুটা সহযোগিতা পাওয়া গেলেও এরপর আর কোনো সরকারি সহযোগিতা তাদের ভাগ্যে জোটেনি। প্রথম অবস্থায় গোখাদ্যের অভাব না থাকলেও এখন খামারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক খাদ্য সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
খামারিরা জানান, ১৯৯০ সালে সর্বপ্রথম এই এলাকায় খামার গড়ে ওঠে। ওই সময়ে বিএনপি সরকার প্রতিটি খামারিকে গরুপ্রতি ৭ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়। মূলত সেই উত্সাহে তারা খামার গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। বর্তমান সরকারের গত সাড়ে ৩ বছরে কোনো খামারিই সরকারি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা দূরের কথা, সরকারি ডাক্তারের সেবা ও ওষুধও পাচ্ছেন না। ফলে নিজ প্রচেষ্টাতেই তাদের টিকে থাকতে হচ্ছে। এছাড়া ফার্মগুলোতে দৈনিক প্রায় ৫০ হাজার লিটার দুধ উত্পাদিত হলেও দুধ প্রক্রিয়াজাত করার কোনো প্লান্ট না থাকায় বাধ্য হয়ে কম দামে মিষ্টি কারখানায় দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে। কোনো প্রযুক্তিগত জ্ঞান না থাকায় প্রতিদিন এক হাজার লিটার দুধ নষ্ট হয়ে যায়। খামার ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ গরু অস্ট্রেলিয়ান জাতের। এর মধ্যে কিছু গাভী ডেনমার্ক ও হল্যান্ডের জাত। প্রতি গাভী থেকে দৈনিক ৮-৩৫ কেজি পর্যন্ত দুধ পাওয়া যায়।
গাভী পালনে সমস্যার কথা জানাতে গিয়ে ফার্ম মালিকরা বলেন, গোখাদ্যে কুঁড়া ভুসি, পাতা ভুসি, মুগ পাউডার, সয়াবিন খৈল ইত্যাদির দাম বেড়েছে। পাশাপাশি খাদ্যে ভেজাল দেয়া হয়। এছাড়া ওষুধের দামও বেড়েছে। শাহ ছমিয়া ডেইরি ফার্মের মালিক ও পটিয়া ডেইরি ফার্ম মালিক সমিতির সেক্রেটারি নাজিমুদ্দিন জানান, ওষুধের মূল্য আগের চেয়ে দু-তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে এক্সট্রোপেন ৪০-৬৫ টাকা, ফোনাপেন ৪৫-৬০ টাকা, হাইড্রোমাক্স ৫০-৭০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। অন্যান্য ওষুধের দামও বেড়েছে।
পটিয়ার উত্পাদিত দুধ দিয়ে বর্তমানে বৃহত্তর চট্টগ্রামের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। চট্টগ্রামের অভিজাত মিষ্টি উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফুলকলি, স্বাদ, বনফুল, জমজম, মধুবন, ওয়েল ফুডসহ প্রায় সব মিষ্টি তৈরির প্রতিষ্ঠান পটিয়ায় ডেইরি ফার্মগুলো থেকে দুধ সংগ্রহ করে। মিষ্টি উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানে দুধ সরবরাহকারী শিকলবাহার নুরুল ইসলাম, শান্তির হাটের হাফেজ আহমদ, কলেজবাজারের জাহিদ ও চরফরিদ এলাকার জাহাঙ্গীর আলম জানান, তারা সকাল ও সন্ধ্যায় খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম শহরে সরবরাহ করেন। প্রতি কেজি দুধ তারা ৩৬ থেকে ৩৮ টাকায় ক্রয় করে ৪০ টাকায় বিক্রি করেন। যথাসময়ে সরবরাহ করতে না পারলে প্রতিদিন কিছু দুধ নষ্ট হয়ে যায়। প্রযুক্তিগত জ্ঞান না থাকায় তারা দুধ সংরক্ষণের জন্য দুধের সঙ্গে বরফ ও কিছু পানি মিশিয়ে থাকেন।
সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষ দু’বছর আগে দুধ প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের জন্য একটি প্লান্ট তৈরি করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। পটিয়া ফার্ম মালিক সমিতির সেক্রেটারি নাজিম উদ্দিন জানান, মিল্ক ভিটা কর্তৃপক্ষ একটি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করলে একদিকে খামারিরা খুবই উপকৃত হবে, অন্যদিকে চট্টগ্রামের চাহিদা মিটিয়ে এ দুধ দেশের অন্যান্য জেলায়ও সরবরাহ করা সম্ভব হবে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এ এলাকায় ভেটেরিনারি হাসপাতাল না থাকায় চিকিত্সকের অভাবে তারা সময়মত গরুর চিকিত্সা দিতে পারেন না। ফলে তাদের অনেক দামি গরু মারা যায়। খামার এলাকা থেকে পটিয়ার সদরের দূরত্ব বেশি হওয়ায় তারা চট্টগ্রাম শহর থেকেই ডাক্তার এনে চিকিত্সা করাতে বাধ্য হন। তিনি অবিলম্বে এলাকার ডেইরি শিল্প টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সেখানে একটি ভেটেরিনারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।
তথ্যসূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ
thanks for your artical