আমার চিকিৎসা জীবনের বিচিত্র কিছু অভিজ্ঞতা

মুরগিকে কাঁচা মাছ খাওয়ানো, গান শোনানো, আলু খাওয়ানো ইত্যাদি ঘটনার মতো আমার চিকিৎসা জীবনে ঘটে যাওয়া মজার আর বিচিত্র কিছু ঘটনা আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করবো।


আমার চিকিৎসা জীবনের শুরু একটা বেসরকারি কোম্পানিতে, ২০০৭ সাল, পোস্টিং- নরসিংদীতে । ইন্টার্নীর সুবাদে ডেইরি বিষয়ে কিছু ব্যবহারিক জ্ঞান হলেও পোল্ট্রি বিষয়ে বলতে গেলে কিছুই না। একদিন এক পোল্ট্রি খামারি এসে তার মুরগি পোস্টমোর্টেম করে দেখতে বলে যে  রাণীক্ষেত ভ্যাক্সিনের টাইটারটা নেমে গেছে কিনা নাকি সালমোনেলা আক্রমন করেছে। সত্যি কথা বলতে এর আগে আমি কোনদিন পোস্টমর্টেম করতেও দেখিনি (হয়তো ফাঁকিবাজ ছাত্র ছিলাম তাই! তবে সে সময় বাকৃবিতে পোস্টমোর্টেম করানো হতো কি না এ বিষয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে, একমাত্র প্যাথোলজিতে মাস্টার্স করা ছাড়া) , নিজে করা তো দূরের কথা। বোঝেন অবস্থা… তখন আমার মনের ভেতর কি ঘটতে পারে তা বোধ করি আপনারা আন্দাজ করতে পারছেন। যাই হোক তবু সাহস করে তার খামারে গেলাম, সে তো আমাকে ব্যাপক সম্মান দিচ্ছে, আমাকে বলল, দাড়ান আমি কাটি, আপনাকে হাত দিতে হবে না, আপনি শুধু দেখে বলেন যে কি সমস্যা। আমি মনে মনে বলি, আহ! কি শান্তি! উনি মুরগি কাটে আর বলে এটা এরকম, এরকম হলে তো তা সালমোনেলার লক্ষণ, তাই না? ইত্যাদি ইত্যাদি.. আমি শুধু বলি হ্যা, হ্যা… অবশেষে পোস্টমোর্টেম সাকসেসফুল! আমরা একটা চায়ের দোকানে বসলাম, আর জীবাণু কিভাবে আমাদের দেহে প্রবেশ করে আর রোগ তৈরি করে বা সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে কিভাবে আমাদের শরীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে তা নিয়ে একটা নাতিদীর্ঘ লেকচার দিয়ে ফেললাম। খামারি তো বেজায় খুশি, তিনি আমাকে বললেন আমি যেন তার খামারটা প্রতি সপ্তাহে একবার দেখে যাই। এরপর থেকে তিনি আমার পরামর্শেই তার খামার পরিচালনা করবেন! আমি আর যাই কোথায়!! ভয় আর ভালো লাগার এক মিশেল অনুভূতি নিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলাম। মনে হলো ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেল! তবে সেদিনই আমি শিখলাম পোস্টমোর্টেম কিভাবে করতে হয়। সাহস করে সেদিন ঐ খামারে গিয়ে ছিলাম বলেই একসময় দিনে ১৫-২০টা পোস্টমোর্টেম করতে পেরেছি।

মুরগিকে গান শোনানো নিয়ে আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি- তখন আমার পোস্টিং বগুড়ায়। আমার কলিগের সাথে একটা খামারে গেলাম, সাধারনত মুরগির খামারে গেলে দূর থেকেই মুরগির শব্দ পাওয়া যায়, কিন্তু এই খামারে আমি কোনরকম মুরগির শব্দ পাচ্ছিলাম না, যে টা পাচ্ছিলাম সেটা হলো গানের আওয়াজ, আর তা বেশ জোরেই। ভেতরে ঢুকে তো আমার চক্ষু চড়ক গাছ! ছয় হাজার মুরগির একটা ফার্ম। অথচ মুরগি যে এখানে আছে তা ২ মিটার দূর থেকেও বোঝার কোন উপায় নেই। আমি অভিভূত হয়ে দেখলাম, লাউডলি সুবীর নন্দীর গান বাজছে.. মুরগি গান শুনছে আর মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে। খামারির সাথে আলাপ করে জানলাম, তার মুরগির ডিম উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে ১২% বেশি! ভাবুন একবার,৬০০০ মুরগি প্রতিদিন ১২% করে বেশি প্রোডাকশান দিলে মাসে কি পরিমান ডিম বেশি উৎপাদিত হচ্ছে? গানের বিটের তালে তালে মুরগিগুলোর মাথার ঝুঁটি তির তির করে কাঁপছে, তাদের মনোযোগ কেবল খাওয়া আর ডিম উৎপাদন… পরে অবশ্য এ সম্পর্কে আরও স্টাডি করে আরো বিস্তারিত জেনেছিলাম।

আরেকটি ঘটনা বলি- তখন আমি চাকরি সূত্রে রংপুরে। একটা ব্রয়লার খামারে গিয়েছি। তো খামারি আমাকে জিজ্ঞেস করছে “ডাক্তারসাব, মুরগিকে মাছ খাওয়ান যাবে?” আমি বললাম “হ্যা, খাওয়ানো যাবে, আপনারা যে খাদ্য খাওয়ান তাতে তো প্রোটিন হিসেবে অনেক সময় শুটকি মাছ ব্যবহার করা হয়েই থাকে।” তিনি বললেন, “না ডাক্তারসাব কাঁচা মাছ খাওয়ান যাবে না?” আমি তো অবাক, “কেন, কাঁচা মাছ খাওয়াতে চাচ্ছেন কেন?” খামারির উত্তর: “না, ডাক্তারসাব, মাছ খুব সস্তা যাচ্ছে তো..!” বলুন, এই অবুঝ খামারিকে আমি আর কী বলতে পারি? শুধু হাসলাম…

যারা পোল্ট্রি প্রাকটিসের সাথে জড়িত তাদের মনে আছে কিনা, গত বছর পোল্ট্রি খাদ্যের দাম অনেক বেশি অন্য দিকে ডিমের দাম খুব কম এই ৪৫০ টাকা/ ১০০ ডিম। সেই সময়ে কিভাবে খাদ্যের খরচ কমানো যায় তাই নিয়ে খামারিদের নানান রকম পরামর্শ দিতে হচ্ছিল। এর মধ্যে একজন খামারি আমাকে বলল মুরগিকে আলু খাওয়ানো যাবে কিনা? আমি তো সমস্যায় পড়ে গেলাম, আলু তো শর্করার উৎস, তাহলে কি ব্যবহার করা যাবে? ইন্টারনেটে সার্চ দিলাম, দেখি এটা নিয়েও গবেষণা হয়েছে, আমি তো অবাক! দেখলাম আলুকে চিপস্‌ এর মতো করে শুকিয়ে গুঁড়ো করে ব্যবহার করা যায়। আমি এই কথ্য নিয়ে গেলাম ঐ খামারির সাথে দেখা করার জন্য গিয়ে দেখি তিনি যথারিতি আলু ব্যবহার করা শুরু করে দিয়েছেন। তবে তা শুকিয়ে নয় সেদ্ধ করে। সেদ্ধ আলু হাত দিয়ে ভেঙ্গে খাবারের উপর দিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন। যদিও আমি তাকে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলেছিলাম, তবু আমি খামারিদের এই উদ্ভাবনি জ্ঞান দেখে অবিভূত না হয়ে পারলাম না, ভাবলাম, হায়রে বাঙ্গালী, তোকে দিয়ে আসলেই সব সম্ভব..

এরকম আরো কত না ঘটনা.. প্রিয় পাঠক, আপনাদের জীবনেও এমনি কোন ঘটনা ঘটে থাকলে তা শেয়ার করতে পারেন.. সবাই ভালো থাকবেন।

লেখকঃ ডাঃ তায়ফুর রহমান

ডাঃ তায়ফুর রহমান; ডিভিএম, এম এস, এমপিএইচ ; ন্যাশনাল টেকনিক্যাল এডভাইজার-এপিডেমিওলজি, জাতিসঙ্ঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা, ঢাকা; ব্লগ এডমিনিষ্ট্রেটর, ভেটসবিডি

এটাও দেখতে পারেন

esta tienda online 1

Las 33 Mejores Tiendas Online En Las Que Comprar Como la mayoría, nos permite devoluciones …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.