দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের লাইভষ্টক পলিসিতে ইনব্রিডিং বিষয়টিকে উৎসাহিত করা হয়েছে ফলে সরকার যাদের মাধ্যমে কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমটি পরিচালনা বা বাস্তবায়ন করছেন তারা মূলত আজ্ঞাবহের কাজটিই করে যাচ্ছেন। সরকারের ২০০৭ সালে প্রকাশিত National Livestock Development Policy তে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনায় বলা হয়েছে “Inseminate cross bred Holstein- Friesian cows with semen of progeny tested 50% Holstein- Friesian bulls (50% Holstein-Friesian X 50% Local).” কিন্তু বাস্তবে আমাদের সাভারস্থ কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রে কি ধরনের জিনপুল সংরক্ষিত আছে? সরকার নিজেই কি তার পলিসিটি সঠিক ভাবে অনুসরণ করছেন? প্রথমত, ২০০৮ সালে প্রকাশিত এক বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রে দেখা যায়, সাভারস্থ কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রে প্রজনন কাজে ব্যবহৃত বা ব্যবহারের জন্য চিহ্নিত ষাঁড়ের পপুলেশনে গড়ে শতকরা ৬০ ভাগ হলস্টিন জাতের জিন রয়েছে যা ফরওয়ার্ড-ক্রস, ব্যাক-ক্রস, ক্রস টু ক্রস ইত্যাদি বিভিন্ন ভাবে সৃষ্ট। বলাই বাহুল্য যে, ইনব্রিডিং এর মাধ্যমে ঐ সমস্ত ক্রসব্রিড ষাঁড়গুলোতে ৬০ ভাগ হলস্টিন জাতের জিনের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। কোনরূপ জেনেটিক টেস্ট বা প্রজেনী পারফরমেন্স ছাড়াই শুধুমাত্র অনুমানের ভিত্তিতে আর গায়ের রঙ পরিবর্তন হয়েছে দেখে ঐ সমস্ত প্রজনন ষাড়গুলো নির্বাচন করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, ঐ ক্রসব্রিড ষাঁড়গুলো তৈরিতে এযাবতকালে আমদানিকৃত মোট কতগুলো হলস্টিন জাতের বিদেশী ষাঁড়ের সিমেন ব্যবহৃত হয়েছে? লক্ষ্য করা যায় যে, জাতীয় পর্যায়ে প্রজনন কাজে ব্যবহারের জন্য ঐ ক্রসব্রিড ষাড়েগুলোর অনেকেগুলোই পেটারনাল সিবলিং। গত ৩০ বছর যাবত মাত্র গুটিকয়েক হলস্টিন জাতের বিদেশী ষাঁড়কে পূনঃপূনঃ ব্যবহারের ফলে ইনব্রিডিং অবস্থাটি আরও একধাপ ত্বরান্বিত হয়েছে। তৃতীয়ত, লক্ষণীয় ওই একই ইনব্রিডিং প্রক্রিয়ায় খামারীর ঘরে পালিত গাভীটিও তৈরি। ফলে সাভারস্থ কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের প্রজনন ষাঁড়ের সিমেন ব্যবহারের মাধ্যমে বছরের পর বছর দেশব্যাপী খামারীর ঘরে যে সব প্রজেনী তৈরি হচ্ছে তাদের মধ্যে ইনব্রিডিং এর মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বলা যায় জাতীয় পর্যায়ে আমাদের প্রানীসম্পদে একটি ইনব্রিডিং ডিপ্রেশন এর সৃষ্টি হয়েছে।
এর সাথে মরার উপর খড়ার ঘায়ের মত যুক্ত হয়েছে বিদেশী জাতের ঐসব হলস্টিন ষাঁড় সমূহের বয়স যাদের থেকে এই ক্রসব্রিড প্রজনন ষাঁড়গুলো তৈরি হয়েছে। এখন থেকে ২০ বা ৩০ বছর আগে জন্মানো আর সম্প্রতি জন্মানো বিদেশী হলস্টিন ষাঁড়টি হতে একই উৎপাদন আশা করা যাবেনা। উদাহরণ স্বরূপ, ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গাভী প্রতি দুধ উৎপাদন ছিল ১০ হাজার লিটার। আর এখন নতুন নতুন জেনোমিক ষাঁড় ব্যবহারের ফলে বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১৫ হাজার লিটার। তার মানে যত সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশে জন্মানো একটি হলস্টিন ষাঁড় দেশে ক্রসব্রিড তৈরিতে ব্যবহার হবে আমাদের উৎপাদনও তত বাড়বে।
বাংলাদেশের পাবনা-সিরাজগঞ্জ জেলা যা মিল্কবেল্ট এলাকা হিসাবে পরিচিত, সেখানকার চিত্র আর সমগ্র দেশের চিত্রটি সম্পূর্ণ আলাদা। সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত না হলেও মিল্ক ভিটার বদৌলতে পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে ইনব্রিডিং এর প্রভাব অনেটাই কম। ২০০৪ সালে প্রকাশিত বিশ্ব খাদ্য সংস্থার এক রিপোর্টে দেখা যায় ১৯৯৬ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে এ অঞ্চলে, গাভীর জাতভেদে, দুধ উৎপাদন ১৪ থেকে ২০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর কারন হিসাবে দেখা যায় যে সেখানে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে গাভীতে প্রতিনিয়তই অধিক উৎপাদনশীল জিন এনফোর্স করা হচ্ছে। যদি পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের দুধ উৎপাদন ও উৎপাদন বৃদ্ধি মোট জাতীয় উৎপাদনের সমীকরণ হতে বাদ দেয়া হয় তা হলে দেশে দুধ উৎপাদনের করুন দশাটি আরও প্রকট হবে।
তবে আশার কথাও আছে অনেক। পানিসম্পদ বিভাগের তথ্য মতে কৃত্রিম প্রজননের হার তো প্রতি বছর ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৮ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে ৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডোজ সিমেন উৎপাদন করা হয়েছে আর তার মাধ্যমে ৫ দশমিক ২ মিলিয়ন প্রজনন হয়েছে। অর্থাৎ, দেশের মানুষ ও কৃষক এখন কৃত্রিম প্রজনন ও তার মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধিতে অধিক সচেতন ও আগ্রহী। সরকারী হিসাবমতে, দেশে বর্তমানে গবাদি পশুর ১৮ ভাগ ক্রসব্রিড জাতের। সে হিসাবে দেশে প্রায় সাড়ে চার মিলিয়ন ক্রসব্রিড রয়েছে। ঐ সাড়ে ৪ মিলিয়ন ক্রসব্রিড গরুর খামারী বাংলাদেশের আবহাওয়ায় ক্রসব্রিড গরু পালনে আজ অভিজ্ঞ। সরকারি ও বেসরকারি প্রচেষ্টায় দেশে বর্তমানে ২০০০ এরও বেশী কৃত্রিম প্রজনন কর্মী তৈরি হয়েছে। যদিও যথেষ্ঠ নয় তারপরও প্রতিটি উপজেলাতে দুইজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা বা ভেটেরিনারিয়ানের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। পানিসম্পদ বিভাগ গত ১৫ বছরে নতুন চারটি ভেটেরিনারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে যার সবগুলোই বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও আরও তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হতে ভেটেরিনারি গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় হতে অসংখ্য বিশ্বমানের ভেটেরিনারি গ্র্যাজুয়েট বর্তমানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে লাইভস্টক সেক্টরের উন্নয়নে নিয়োজিত। সর্বোপরি, দেশে বর্তমানে একটি সুশৃঙ্খল ও নির্ভরযোগ্য কৃত্রিম প্রজনন নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। নিঃসন্দেহে এসবই প্রাণীসম্পদ বিভাগের বহু সাফল্যের মাত্র কিছু উদাহরন যা দেশে ডেইরী শিল্প উন্নয়নের জন্য অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।
সরকারের উচিত হবে ঐ সাড়ে ৪ মিলিয়ন ক্রসব্রিড পালনকারী খামারীদেরকে বানিজ্যিক দুগ্ধ খামারীতে উত্তরণে সহায়তা করা। এজন্য সরকারী ও বেসরকারী যৌথ উদ্যোগে এখন প্রয়োজন এমন একটি মেজারেবল ও প্রেডিক্টেবল জিনপুল তৈরি করা এং তা নিয়ে কাজ করা যা দেশের ঐ ১৮ ভাগ ক্রসব্রিড গাভীতে আউটব্রিডিং এর মাধ্যমে ২৫-৩০ লিটার দুধ উৎপাদনে সাহায্য করে। সাড়ে চার মিলিয়ন ক্রসব্রিড গরুর অর্ধেক গাভী, আর ঐ গাভী গুলোর যদি অর্ধেক সংখ্যকও দুগ্ধবতী হয় তবে অনায়াসেই দেশে বছরে ৯ থেকে ১০ মিলিয়ন মেট্রিকটন মেট্রিক টন দুধ উৎপন্ন হবে। যদি এখনই সে উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে আগামী পাঁচ বছরেই দুধ উৎপাদনে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। এদেশ আজ সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে খাদ্যশস্য উৎপাদনে সয়ং সম্পূর্ণ হয়েছে। ষোল কোটি মানুষের স্বার্থে দেশে “শ্বেত বিপ্লব” এখন একটি সময়ের দাবী।
সম্পূর্ণ নিবন্ধটি দৈনিক আমাদের সময়, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি ও দৈনিক ইত্তেফাক -এ প্রকাশিত হয়েছে।
খুব ভাল লেগেছে
আর জানতে চায়
ভাল