অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে দুধের উৎপাদন, সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি ও এ সংক্রান্ত বেশকিছু রিপোর্ট বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। স্বভাবিকভাবেই অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে বর্তমানে বাংলাদেশে দুধের উৎপাদন কত? অত্যন্ত সময়োপযোগী এ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেকেই হয়ত চমকে উঠবেন। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সূত্রমতে, ২০১০ সালে সারাবিশ্বে মোট দুধ উৎপাদন হয় ৫৯৯.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন। সর্বাধিক ৮৭.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন দুধ উৎপন্ন করে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এক নম্বরে। দুধ উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানটি দখল করে আছে ভারত (৫০.৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন) আর তৃতীয় স্থানে আছে চীন (৩৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন)। বর্তমানে পাকিস্তানে দুধ উৎপন্ন হয় ১২.৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন আর বাংলাদেশে তা হচ্ছে ০.৮৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ১৯৬১ সালে সারা বিশ্বে মোট দুধ উৎপাদিত হয়েছে ৩১৩.৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন। কৃত্রিম প্রজনন নামক জৈবপ্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে বর্তমানে বিশ্বে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ষাটের দশকে বিশ্বব্যপী কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তি একটি ইন্ডাস্ট্রির রূপ লাভ করে। কৃত্রিম প্রজনন ব্যবহারের ফলে ১৯৫৯ হতে ১৯৯০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে দুগ্ধ উৎপাদনকারী গাভীর সংখ্যা কমানো সম্ভব হয়েছে ৪০ শতাংশ কিন্তু একই সময়ে দুধ উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণ। অর্থাৎ গাভীপ্রতি দুধের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও কৃত্রিম প্রজনন শুরু হয়েছে ষাটের দশকের প্রথম দিকে।
জার্মান সহায়তায় ঢাকার সাভারে আমাদের নিজস্ব কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রটি চালু হয় ১৯৬৯ সালে। কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রটি স্থাপনের পর প্রাথমিক সফলতা হিসাবে দেখা যায় মাত্র ১০ বছরে দুধ উৎপাদন ০.৬৬৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ০.৯৪৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন। দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির ঐ হার সেই সময়কালে সারা বিশ্বে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির হারের সাথে তুলনাযোগ্য।
কিন্তু তারপরই নামে ধস। সারা দেশব্যাপী কৃত্রিম প্রজনন নেটওয়ার্ক ও প্রজনন কার্যক্রম জোরদার করা হলেও দুধের উৎপাদন পর্যায়ক্রমে কমতে থাকে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তথ্যমতে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে দুধের উৎপাদন কমে দাঁড়ায় মাত্র ০.৮৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন। অথচ এই সময়ে দেশে গবাদি পশুর সংখ্যা কমেনি বরং বেড়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না- গত ৩০ বছরে আমাদের দেশে গাভীপ্রতি গড় দুধ উৎপাদন কমেছে। অথচ এ সময়কালে ভারতে দুধ উৎপাদন ১৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন থেকে বেড়ে হয়েছে ৫০ মিলিয়ন মেট্রিক টন আর পাকিস্তানে তা ২ মিলিয়ন মেট্রিক টন থেকে বেড়ে হয়েছে ১২.৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
কৃত্রিম প্রজনন একটি জৈবপ্রযুক্তি যার যথাযথ ব্যবহার বয়ে আনতে পারে অভূতপূর্ব সফলতা আর সামান্য ভুলই তৈরি হতে পারে এক ভয়ঙ্কর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। বাঙালি জাতিকে দুধে-ভাতে রাখার স্বপ্নে আমাদের পূর্বসূরিরা যে কাজটি শুরু করেছিলেন অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে, আজ আমাদেরই ভুলে সে স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্ন। এ ভয়াবহ দুঃস্বপ্নটি বুঝার জন্য ৩০ বছর অত্যন্ত লম্বা সময় তবে আশার কথা হল এখনও সময় আছে জেগে ওঠার। পদ্ধতিগত পরিবর্তন এনে ইনব্রিডিং নামক ভয়ঙ্কর এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের হাত থেকে প্রাণীসম্পদ রক্ষা করার এখনই সময়।
এই লেখাটি ইতোপূর্বে আমাদের সময় , আমাদের অর্থনীতি ও ইত্তেফাক এ প্রকাশিত হয়েছে
এই বিষয়ে আরোও জানতে পড়ুন প্রানীসম্পদে ইনব্রিডিং নামক ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের স্বরূপ (১)
//
‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না। দয়া করে যদি বুঝিয়ে বলতেন…
ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হচ্ছে মেরী শেলী কর্তৃক রচিত (1823) জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস (Science Fiction) “ফ্রাঙ্কেনস্টাইন” এর মূল চরিত্র যাকে পরীক্ষাগারে সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু পদ্ধতিগত ভুলের ফলে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠে এক ভয়ানক দানব যা পরবর্তীতে সে তার স্রষ্টাকেও কে ধ্বংস করতে চায়। এই নিবন্ধে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত।
দারুন! আপনার কাছ থেকে দেশের ভেটেরিনারিয়ানবৃন্দ অনেক কিছু আশা করে। আশা করি এরকম সুন্দর সুন্দর আর্টিকেল আমরা আরো পাব। ভেটেসবিডি-তে আপনার পথ চলা আরো সরব হয়ে উঠুক। ধন্যবাদ।