পানির অপর নাম জীবন। খাদ্য গ্রহন না করেও কিছু সময় বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু পানি গ্রহন ছাড়া একটুও চলে না। পানি একটি অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান। পানি শরীরকে সতেজ রাখে, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করে এবং খাদ্য পরিপাকে দ্রাবক হিসাবে কাজ করে,শরীরে উৎপাদিত বর্জ্য অপসারনে সহায়তা করে। শরীরে পুষ্টি,ঔষুধ এবং ভ্যাক্সিন প্রবেশের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে। শরীরের ভিতরে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় ও রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মাধ্যম হিসাবে কাজ করে। মুরগি তিনটি উৎস থেকে পানি পেয়ে থাকে। (১) সরবরাহকৃত পানি (drinking water) –মুরগিকে যে পানি সরবরাহ করা হয় তা থেতে যে পানি পায় তা এই পানি । মুরগির গৃহিত পানির শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি এই পানি (২)খাদ্য থেকে প্রাপ্ত পানি- খাদ্য উপাদানে যে পানি থাকে (moisture) অর্থাৎ এই পানি বলতে গৃহিত খাদ্যের moisture বুঝায়। (৩) মেটাবলিক পানি – এটা হলো রাসায়নিক পানি (H2O) শরীরের ভিতরে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সময় এই পানি পাওয়া যায়।
পানির প্রয়োজনীয়তা নির্ধারনঃ মুরগিকে পর্যাপ্ত পরিমান পরিষ্কার,বিশুদ্ধ ও সতেজ পানি সরবরাহ করা উচিত। সাধারণত: মুরগি স্বাভাবিক অবস্থায় যে পরিমান খাদ্য খায় তার দ্বিগুন পরিমান পানি গ্রহন করে। অর্থাৎ খাদ্য ও পানি গ্রহনের অনুপাত হলো ১ঃ২। তবে কতকগুলো ফ্যাক্টর মুরগির পানি গ্রহনের এই অনুপাতকে প্রভাবিত করে যেমন- খাদ্য গ্রহন,পরিবেশের তাপমাত্রা, সরবরাহকৃত পানির তাপমাত্রা,মুরগির সুস্থতা, পানি সরবরাহ পদ্ধতি, পানির গুনগতমান, খাদ্যে লবন এবং খনিজ পদার্থের উপস্থিতি, সরবরাহকৃত খাদ্যের ধরন (ম্যাশ, পিলেট, ক্রাম্বল), ঔষুধ ব্যবহার ইত্যাদি।
খাদ্য গ্রহনঃ সাধারনত: মুরগি যে পরিমান খাদ্য খায় তার দ্বিগুন পানি গ্রহন করে (generally water intake = 2x feed intake)। মুরগির খাদ্যে যদি খনিজ উপাদানের ( লবণ) পরিমান বেশি হয় তাহলে পাতলা পায়খানা হবে এবং এর ফলে মুরগি পানি শূণ্যতায় ভুগবে। আবার ম্যশ ফিড সরবরাহ করলে পানি বেশি খায়।
পরিবেশের তাপমাত্রাঃ পানি গ্রহন,খাদ্য গ্রহন এবং তাপমাত্রা পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত। পরিবেশের তাপমাত্রা কম হলে পানি গ্রহন কম হয় এবং খাদ্য গ্রহন বেশি হয়। নিচের টেবিলের মাধ্যমে পরিবেশের তাপমাত্রার সাথে খাদ্য ও পানি গ্রহনের সম্পর্ক উল্লেখ করা হলোঃ
তাপমাত্রা ( ০C) | পানিঃ খাদ্য গ্রহন |
২০ | ২ঃ১ |
২৬ | ২.৫ঃ১ |
৩৭ | ৫ঃ১ |
উপরের টেবিলে দেখা যাচ্ছে যে যখন স্বাভবিক তাপমাত্রায় ( ২০ ডিগ্রি সে.) যে পরিমান খাদ্য খায় তার দ্বিগুন পরিমান পানি গ্রহন করে। আবার পরিবেশের তাপমাত্রা যখন ৩৭ ডিগ্রি সে. তখন যে পরিমান খাদ্য খায় তার পাঁচগুন পানি গ্রহন করে।
সরবরাহকৃত পানির তাপমাত্রাঃ পানি খুব বেশি ঠান্ডা বা খুব বেশি গরম হলে পানি গ্রহনের পরিমান কমে যায়। পানির তাপমাত্রা ১০-১৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এর মধ্যে হলে মুরগি স্বাভাবিক পরিমান পানি গ্রহন করে। পানির তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এর নিচে হলে পানি গ্রহন কমে যায়। আবার পানির তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেঃ এর উপরে হলেও পানি গ্রহনের পরিমান কমে যায়।
পানির তাপমাত্রার সাথে পানি গ্রহনের পরিমানের সম্পর্ক নিচের টেবিলে উল্লেখ করা হলো
পানির তাপমাত্রা | পানি গ্রহন |
৫ ডিগ্রি সেঃ এর নিচে | পানি খুব ঠান্ডা ,পানি গ্রহ্রনের পরিমান খুব কম |
১০ -১৪ ডিগ্রি সেঃ | স্বাভাবিক পরিমান পানি গ্রহন |
৩০ ডিগ্রি সেঃ এর বেশি | পানি খুব গরম ,পানি গ্রহ্রনের পরিমান খুব কম |
মুরগির সুস্থতাঃ পানি গ্রহনের পরিমানের দ্বারা মুরগির স্বাস্থ্যগত অবস্থা সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। সব কিছু স্বাভাবিক থাকার পরেও মুরগি যদি হঠাৎ করে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা বেশি পরিমান পানি গ্রহন করে তাহলে বুঝতে হবে মুরগি যে কোন ধরনের অসুখে ভুগবে। এবং রোগের লক্ষণ দৃশ্যমান হলে পানি গ্রহনের পরিমান অবশ্যই কমে যাবে।
পানির গুনগতমানঃ ভালো গুণগত মানের পানি হলো স্বাদহীন,বর্ণহীন তরল পদার্থ। পানির কোয়ালিটি দুটি দৃষ্টিকোন থেকে নির্ণয় করা হয় আর তা হলো পানিতে গ্রহনযোগ্য মাত্রায় ব্যকটেরিয়া এবং বিভিন্ন রাসায়নিক বস্তর উপস্থিতি। তবে সরবরাহকৃত পানি কোয়ালিটি খারাপ হলে পানি গ্রহন কম হয়। পানির রাসায়নিক ও ব্যাকটেরিওলজিক্যাল গুনাগুন নিম্নে উল্লেখ করা হলো
পানের যোগ্য পানিতে রাসায়নিক বস্তর উপস্থিতি নিম্নরুপ ঃ-
রাসায়নিক গুণাগুন | গ্রহনযোগ্য মাত্রা | একক |
এসিডিটি | ৫-৬ | pH |
অ্যামোনিয়া | < ০.২ | mg/litre |
নাইট্রাইট | < ০.০৫ | mg/litre |
নাইট্রেট | < ২৫ | mg/litre |
ক্লোরাইড | < ১০০ | mg/litre |
লবণ | < ৩৫০ | mg/litre |
আয়রণ | < ০.২ | mg/litre |
অক্সিডিটি | < ৫০ | |
ক্ষারত্ব | < ১৫ | |
সালফেট | < ১০০ | mg/litre |
ম্যাঙ্গানিজ | < ১ | mg/litre |
ব্যবহার উপযোগি এবং অনুপযোগি পানিতে ব্যকটেরিয়ার উপস্থিতির পরিমানঃ
জীবাণু | মানুষের পানের যোগ্য পানি | এনিম্যালের গ্রহন যোগ্য পানি |
৩৭ ডিগ্রি সেঃ তাপমাত্রায় মোট জীবানুর গ্রহনযোগ্য উপস্থিতি | < ১০ | <১০০ |
মোট কলিফরম/১০০ মিলি | অনুপস্থিত | <৫ |
ফিক্যাল কলিফরম/১০০ মিলি | অনুপস্থিত | <৫ |
ফিক্যাল ষ্টেপটোকক্কাই | অনুপস্থিত | <৫ |
প্যাথোজেনিক ষ্টেপটোকক্কাই | অনুপস্থিত | ৫ |
মুরগিকে পর্যাপ্ত পরিমান জীাবণুমুক্ত,বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ কবতে হবে। যদি পর্যাপ্ত পরিমান পানি সরবরাহ করা না হয় তাহলে কিডনি আক্তান্ত হবে এবং এর কার্যকরিতা কমে যাবে। ফলে উৎপন্ন বর্জ্য নিষ্কাষণ বাধাগ্রস্থ হবে এবং মুরগি নানাবিধ জটিলতায় ভুগবে। আমরা জানি পানি মুরগিকে টিকা প্রদানের একটি অন্যতম মাধ্যম। পানির গুনগতমান নিম্ন হলে ব্যবহৃত টিকার কার্যকরিতা কমিয়ে দেয় এমনকি টিকা অকার্যকর হয়ে যায়। তাছাড়া মুরগিকে সরবরাহকৃত পানি দূষিত হলে মুরগি বিবিধ রোগে আক্রান্ত হয়।
পানি সরবরাহ পদ্ধতিঃ বিভিন্ন ধরনের পানি সরবরাহ পদ্ধতি পানি গ্রহনের পরিমানকে প্রভাবিত করে। যদি মুরগির ঘরে পর্যাপ্ত পরিমান পানির পাত্র সরবরাহ করা না হয় তাহলে এ বিষয়টিও পানি গ্রহনের পরিমানকে প্রভাবিত করে। পানির পাত্র কম হলে পানি গ্রহনও কম হবে। আবার একটি পানির পাত্র থেকে আরেকটি পানির পাত্র কত দূরত্বে স্থাপন করতে হবে সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। বিভিন্ন ধরনের পানির পাত্রে প্রতিটি মুরগির জন্য যদি জায়গা কম হয় অর্থাৎ একটি পানির পাত্রে যতগুলো মুরগির জন্য পানি গ্রহন স্বাচ্ছ্যন্দময় হয় তার চেয়ে বেশি সংখ্যক মুরগি থাকলে পানি গ্রহন কম হয়। পানি পাত্রে একটি মুরগির জন্য কতটুকু জায়গা দরকার তা নিচে উল্লেখ করা হলো।
মুরগি | j¤^v পানির পাত্রসেমি/মুরগি | গোলাকার পাত্রসেমি/মুরগি | নিপল ড্রিংকারপ্রতি নিপলে মুরগির সংখ্যা | কাপ ড্রিংকারপ্রতি কাপে মুরগির সংখ্যা |
লেয়ার গ্রোয়ার (০-১৮ সপ্তাহ) | ১.৬ | ০.৬ | ১৫ | ২৫ |
লেয়ার | ২.০ | ০.৮ | ১২ | ২০ |
ব্রয়লার প্যাঃ স্টক গ্রোয়ার (০-১৮ সপ্তাহ) | ২.০ | ১.০ | ১০ | ২৫ |
ব্রয়লার | ০.৮ | ০.৬ | ১২ | ৩০ |
ড্রিংকার টু ড্রিংকার দুরত্ব
লেয়ার এবং ব্রয়লার সর্বনিম্ন ৪০ সেমি
ব্রয়লার ব্রিডার সর্বনিম্ন ৬০ সেমি
ডে-ওল্ড চিকের জন্য নিপল ড্রিংকিং সিস্টেম সুবিধাজনক নয়। আবার বেল টাইপ ড্রিংকারে পানি পেতে কম প্রেসার লাগে বলে সহজেই পানি গ্রহন করতে পারে যা মুরগির পানি গ্রহনের পরিমানকেও প্রভাবিত করে। অর্থাৎ যে পদ্ধতিতে মুরগি সহজে পানি পায় সে পদ্ধতিতে পানি গ্রহনের পরিমানও বেশি হয়।
ঔষুধ ব্যবহারেঃ মুরগি অসুস্থ হলে পানিতে বিভিন্ন ধরনের ঔষুধ প্রযোগ করা হয় এবং অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ব্যবহার করা হয়। যে কোন ধরনের ঔষুধ ব্যবহারের সময় মুরগি কম পরিমান পানি খায়। আবার খাদ্যের সাথেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের ঔষুধ ( ককসিডিওস্ট্যাট),টিকাবীজ ব্যবহার করা হয় এর ফলেও পানি কম খেতে পারে।
ভ্যাক্সিনেশনের জন্য পানির পরিমান নির্ধারনঃ মুরগিকে বিভিন্ন ভাবে ভ্যাক্সিন প্রদান করা হয়ে থাকে যেমন, চোখে ড্রপ,ইনজেকশনের মাধ্যমে, স্প্রে এর মাধ্যমে এবং পানি খাওয়ানোর মাধ্যমে। পানি খাওয়ানোর মাধ্যমে ভ্যাক্সিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে কতটুকু পানি দরকার হবে তা নিম্নের সুত্রের সাহায্যে নির্ণয় করা যায়।
** ১০০০ বাচ্চার জন্য পানির পরিমান = মুরগির বয়স(দিনের সংখ্যা)
যদি একটি ফ্লকে ২০০০ বাচ্চা থাকে এবং বয়স ১৫ দিন হয় তাহলে ভ্যাক্সিনের জন্য ৩০ লিটার পানির দরকার হবে। এই সুত্রটি কেবলমাত্র প্রথম ২১ দিন বয়সের পর্যন্ত ভ্যাক্সিনেশনের জন্য প্রযোজ্য।
পরিচ্ছন্নতায় পানিঃ মুরগি পালনের ক্ষেত্রে মুরগিকে পানি খাওয়ানো ছাড়া অন্যান্য কাজে পানির গুরুত্ব আমরা অনেক সময় এড়িয়ে যায়। পানের প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও পানি গরমের সময় মুরগি এবং ঘরের পরিবেশ ঠান্ডা রাখে। নতুন ব্যাচের বাচ্চা শেডে আসার পূর্বে শেড পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে পানির দরকার হয়। প্রতি কেজি ব্রয়লারের মাংশ উৎপাদনে গড়ে ৩ লিটার পানির দরকার হয় এবং এর উপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যায়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী Mike Czarick হিসাব করে দেখিয়েছেন যে একটি আদর্শ পোল্ট্রি হাউজ ( ৪০x৫০০ ফুট) এ ২৪,০০০ মুরগি পালন করলে ৭ ঘনমিটার পানির দরকার হয় এবং প্রতি মিনিটে সবোর্চ্চ পানির ব্যবহার( peak water consumption) ১০ লিটার।
উপরের আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে জীবনের জন্য পানি একটি অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান। পানি গ্রহনের পরিমান দ্বারা পাখির সুস্থতা পরিমাপ করা যায়। পানির অভাবে মুরগির উৎপাদনশীলতা বিঘ্নিত হয় এমন কি উৎপাদ (product) এর গুনাগতমান ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যেমন স্বাভাবিকের চেয়ে পানি গ্রহনের পরিমান কম হলে লেয়ারের ক্ষেত্রে ডিমের খোসা পাতলা হয়। সুতরাং মুরগি পালনের ক্ষেত্রে সরবরাহকৃত পানির গুনগতমান এবং মুরগির পানি গ্রহন মনিটরিং করা জরুরী।
তথ্যসুত্র ঃ ওয়াল্ড পোল্ট্রি ম্যাগাজিন
thanx for this kind of article.hope more article we will get from you.
খুবই সুন্দর লেখা। water intake = 2x feed intake) , কবুতরের ক্ষেত্রেও কি এমন হবে? বিস্তারিত জানতে চাই।