ভ্যাক্সিন (Vaccine) বা টীকা হল এক ধরনের পদার্থ বা মিশ্রন যা অ্যান্টিবডি তৈরী হওয়ার প্রক্রিয়াকে উত্তেজিত করে দেহে কোন একটি রোগের জন্য প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি জন্মাতে সাহায্য করে । কোনো প্রাণীর দেহে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস(Virus), ব্যাক্টেরিয়া (Bacteria) ইত্যাদির জীবিত (রোগসূচনাকারী ক্ষমতা শূন্য) বা মৃতদেহ বা কোনো অংশবিশেষ হতে প্রস্তুত ঔষধ যা ঐ প্রাণীর দেহে ঐ ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে আন্টিবডি (Antibody)সৃষ্টি করে। কোন রোগের টীকা হল কেবলমাত্র সেই নির্দিষ্ট রোগটিরই বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা বর্ধনকারী ক্রিয়া সম্পন্ন জৈব উপাচার যা টিকাকরণ (ইনঅক্যুলেশন) অর্থাৎ ত্বকে সূচ ফুটিয়ে দেওয়া হতে পারে বা অন্য উপায়ে যেমন খাবার ড্রপ (যেমন ওরাল পোলিও ভ্যাক্সিন) হিসাবে দেওয়া হতে পারে।৪২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডিডেস (Thucydides) লক্ষ্য করেন যে এথেন্স শহরে যেসব রোগী স্মলপক্স আক্রান্ত হবার পর বেঁচে যাচ্ছে তাদের পুনরায় আর এই রোগটি হচ্ছে না। পরবর্তীতে চীনারা সর্বপ্রথম ১০ম শতাব্দীর শুরুতে ভ্যাক্সিনেশন এর আদিরূপ ভ্যারিওলেশন (Variolation) আবিষ্কার করে। এই প্রক্রিয়ায় স্মলপক্স রোগে আক্রান্তদের দেহের পাঁচড়া (Scrab) হতে টিস্যু নিয়ে সুস্থ মানুষদেরকে এর সংস্পর্শে আনা হত। সর্বপ্রথম ১৭৯৬ সালে ভ্যাক্সিন আবিস্কার করেন এডওয়ার্ড জেনার। এজন্যে তাঁকে “ফাদার অব ইম্যুনিলোজি” বলা হয়। তিনি এক গোয়ালিনীর কাছ থেকে জানতে পারেন তার কখনও গুটিবসন্ত হয় নি কারণ তার আগে গোবসন্ত হয়েছিল। জেনার গোয়ালিনীর এই তথ্যকে তার পরীক্ষায় ব্যবহার করেন। জেনার আট বছর বয়সী এক ছেলের বাহুতে গোবসন্তের ফুস্কুড়ি প্রবেশ করান। ফলে ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর ছেলেটি আর কখনও গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয় নি। কিন্তু এটি কিভাবে কাজ করেছে এডওয়ার্ড তা জেনার জানতেন না। পরবর্তীতে এ পাস্তুর বের করেন কিভাবে এ পদ্ধতিটি কাজ করে। পাস্তুর এর নাম দেন ভ্যাক্সিন। ভ্যাক্সিন নামটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘Vacca” যার মানে গরু। জেনারের কাজের প্রতি সম্মান দেখিয়ে পাস্তুর এই নামটি রাখেন। পাস্তুর রেবিস ও এন্থ্রাক্সের ভ্যাক্সিন আবিস্কার করেন। ভ্যাক্সিন আবিস্কারের ক্ষেত্রে অন্যতম একজন ব্যক্তিত্ব হলেন Maurice Hilleman। তিনি হাম, মাম্পস, হেপাটাইটিস এ, হেপাটাইটিস বি, জলবসন্ত, মেনিনজাইটিস, নিউমোনিয়া ও ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাক্সিন আবিস্কার করেন। এখন চলুন জেনে নেই কিভাবে ভ্যাক্সিন কাজ করে। যেকোন জীবাণুর আছে দুইটি বৈশিষ্ট্য- একটি হল রোগ সৃষ্টি করা (Pathogenecity)। অন্যটি দেহের অভ্যন্তরে ঐ একই রোগের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য কিছু পদার্থ (Antibody) তৈরী করা। ভ্যাক্সিন তৈরীর সময় রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাটিকে নষ্ট করে দেয়া হয়। কিন্তু অন্য বৈশিষ্ট্যটি ঠিক রাখা হয়। সোজা বাংলায় রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাহীন জীবাণুকেই ভ্যাক্সিন হিসেবে দেহে প্রবেশ করানো হয়। ফলশ্রুতিতে এই জীবাণু দেহে রোগের কারণ হয় না, উল্টো রোগটি যেন না হয় তার জন্য বিশেষ পদার্থ(Antibody) তৈরী করতে থাকে। আরেকটি সুবিধা হল এই জীবাণুগুলো মেমরি সেল গঠন করে ফলে পরবর্তীতে একই জীবাণু পুনরায় প্রবেশ করলে সহজে সনাক্ত করতে পারে। এভাবে ভ্যাক্সিন শরীরের ইম্যুনিটি-কে বাড়িয়ে দেয়। ইঞ্জেকশন বা মুখে খাওয়ার মাধ্যমে ভ্যাক্সিন দেয়া যায়। ভ্যাক্সিনেশন দুই প্রকার- রোগ হবার আগেই ভ্যাক্সিন দেয়া (Active) আর রোগ হবার পরে দেয়া(Passive)। অনেক সময় একটি ভ্যাক্সিনের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এর সাথে আরেকটি ভ্যাক্সিন যোগ করা হয়। একে এডজুভেন্ট (Adjuvant) বলে। যেমন অ্যানথ্রাক্স ভ্যাক্সিনের সাথে পারটুসিস ভ্যাক্সিন যোগ করলে অ্যানথ্রাক্সের কাজ করার গতি বৃদ্ধি পায়। আবার ভ্যাক্সিন যাতে দূষিত না হয় এজন্য অনেক সময় এর সাথে প্রিজারভেটিভ (Preservative) মেশানো হয়। কয়েক ধরণের ভ্যাক্সিন আছে। এক ধরণের ভ্যাক্সিন হলো মৃত অণুজীব দিয়ে তৈরি, আর কিছু ভ্যাক্সিনে জীবিত অণুজীবটিই ব্যবহার করা হয় কিন্তু তার রোগ তৈরির ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে অণুজীবের অংশ বিশেষ ব্যবহার করা হয়। সেক্ষেত্রে সেই অংশ বিশেষের রোগ তৈরির ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়া হয়। আরও কয়েক ধরণের ভ্যাক্সিন আছে। যেমনঃ ডিএনএ ভ্যাক্সিন, সাবইউনিট ভ্যাক্সিন, কনজুগেট ভ্যাক্সিন, পলিসেকারাইড ভ্যাক্সিন, আউটার ভ্যাক্সিন। এখন আমরা দেখি কিভাবে ভ্যাক্সিন তৈরি করা হয়। প্রথমে এন্টিজেন তৈরি করা হয়। ভাইরাসকে প্রাথমিক কোষ যেমন মুরগির ডিম অথবা ধারাবাহিক কোষ (Continuous Cell) যেমন মানুষের কোষের কালচারে তৈরি করা হয়। আর ব্যাকটেরিয়াকে তৈরি করা হয় বায়োরিয়েক্টরে। আবার ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়ার রিকম্বিনেন্ট প্রোটিনকে ইস্ট, ব্যাকটেরিয়া কিংবা কোষের কালচারে দিয়ে এন্টিজেন তৈরি করা যেতে পারে। রিকম্বিনেন্ট প্রোটিনের ক্ষেত্রে সেটিকে আলট্রাফিকেশন ও কলাম ক্যামোথেরাপির মাধ্যমে শুদ্ধ করা হয়। অবশেষে এর সাথে সহযোগী বস্তু (Adjuvant), স্টেবিলাইজার ও রাসায়নিক সংরক্ষক (Preservative) ব্যবহার করে ভ্যাক্সিন তৈরি করা হয়। সহযোগী বস্তু অ্যান্টিজেনের কার্যকারিতা বাড়ায়, স্টেবিলাইজার এটিকে বেশি সময় সংরক্ষণে সাহায্য করে। আর রাসায়নিক সংরক্ষক ভ্যাক্সিনকে অন্য কোন কিছু দিয়ে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। পৃথিবী থেকে এ পর্যন্ত একমাত্র যে রোগটি ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে নির্মূল হয়েছে সেটি হচ্ছে গুটিবসন্ত। সর্বশেষ ১৯৭৭ সালে সোমালিয়ায় গুটিবসন্ত দেখা গিয়েছিল। WHO ২০০০ সালের মধ্যে পোলিও রোগ নির্মূলের লক্ষ্যসীমা ঠিক করেছিল। লক্ষ্যসীমাটি পূর্ণ না হলেও পোলিও এখন প্রায় নির্মূলের পথে।
বিষয়বস্তুটিকা ভ্যাক্সিন ভ্যাক্সিন তৈরি
এটাও দেখতে পারেন
বন্যা কবলিত এলাকার প্রাণিদের জন্য করণীয়
আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ কুড়িগ্রাম লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। প্রায় সকলের বাড়িতেই পানি …