রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল-অবরোধে গত ৩ মাসে পোল্ট্রিশিল্পে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সহিংসতা অব্যাহত থাকলে পোল্ট্রিশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে বলে দাবি পোল্ট্রিশিল্প সংগঠনের নেতাদের। তারা জানান, ডিম, বাচ্চা, মুরগি, ফিড খাতে লোকসান তিন হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ব্যাংক সুদ, গাড়ি ভস্মীভূতসহ অন্য ক্ষতি যোগ করা হলে লোকসানের পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। উদ্যোক্তারা জানান, হরতাল-অবরোধে ডিম, বাচ্চা, মুরগি ও ফিড সরবরাহকারী গাড়ি ভাংচুর হচ্ছে।এ শিল্প রক্ষায় বিরোধের অবসান করে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন তারা। বুধবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাব কনফারেন্স লাউঞ্জে ‘মিট দি প্রেস’ অনুষ্ঠানের সংগঠনের নেতারা এ দাবি করেন।
সংবাদ সম্মেলনে এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মোঃ হেলাল উদ্দিন বলেন, “রাজনীতির আগুনে পুড়ছে বাংলাদেশের পোল্ট্রিশিল্প।”
বাংলাদেশ পোল্ট্রিশিল্প ইন্ডাষ্ট্রিজ কো-অর্ডিনেশন কমিটির আহবায়ক মশিউর রহমান বলেন,‘ এ শিল্পে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। প্রায় ৩০ শতাংশ খামার এরইমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। যারা টিকে আছে তারাও পথে বসার পথে। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এ শিল্পে যে ক্ষতি হয়েছে তা বহনের সামর্থ্য খামারিদের নেই।’
এ শিল্প রক্ষার আকুতি জানিয়ে তিনি বলেন,‘ এ শিল্প বাঁচাতে হলে ডিম ও মাংস উৎপাদনকারী পোল্ট্রি খামারি, ব্রিডার্স, ফিড প্রস্তুতকারক এবং বিপণনকারীসহ পোল্ট্রিখাতের অপরাপর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক ঋণ পুন: তফসিল করাসহ সুদ মাফ করতে সরকারের প্রতি দাবি জানাই।’
তিনি বন্ধ হয়ে যাওয়া খামারগুলো পুনরায় চালুর জন্য আর্থিক সহায়তা, পোল্ট্রি সেক্টরে স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে আর্থিক প্রণোদনা এবং পোল্ট্রিখাতে সাম্প্রতিক সময়ে যে লোকসান হয়েছে তা পুষিয়ে দিতে আর্থিক সহায়তাসহ সাত দফা দাবি জানান।
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি) মহাসচিব সাইদুর রহমান বাবু বলেন, ‘৩৫ টাকা খরচ করে যে বাচ্চা উৎপাদন করা হয় তা গড়ে মাত্র ১৫-২০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। ১১০-১২০ টাকায় এক কেজি ওজনের যে মুরগি উৎপাদন করে তা ৭০-৮০ টাকা বিক্রি করতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন,‘ প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ব্রয়লার বাচ্চা (ডিওসি) উৎপাদিত হচ্ছে। হরতাল-অবরোধের কারণে প্রায় ৩০ শতাংশ বাচ্চা অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। এতে বিগত ৩ মাসে ব্রয়লার বাচ্চায় প্রায় ১৬৪ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। বাকী ৭০ শতাংশ বাচ্চা খরচের চেয়েও কম বিক্রি করায় লোকসান হয়েছে প্রায় ২১৮ কোটি টাকা। মোট বাচ্চায় ক্ষতি হয়েছে ৩৮২ কোটি টাকা।’
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ফিআব) সাধারণ সম্পাদক ফজলে রহিম খান শাহরিয়ার বলেন,‘ বিগত ৩ মাসে উৎপাদনের চাহিদা ছিল প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন। যার মূল্য ছিল ২৪ শ’ কোটি টাকা। হরতাল-অবরোধের কারণে ৩৫-৪০ শতাংশ চাহিদা কম থাকায় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।’
বাংলাদেশ এগ প্রডিউসারস এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তাহের আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, প্রতি সপ্তাহে ডিম উৎপাদিত হয় প্রায় ১০ কোটি ৫০ লাখ পিস। হরতাল-অবরোধের কারণে নষ্ট হচ্ছে কিংবা অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে ৩০ শতাংশ ডিম। এতে গত ১৩ সপ্তাহে লোকসান হয়েছে প্রায় ২৬৬ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ৭০ শতাংশ ডিম খামারিকে বিক্রি করতে হয়েছে গড়ে প্রায় ৫ টাকা দরে অথচ উৎপাদন খরচ ৬ টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে ডিম বিক্রি করে লোকসান হয়েছে প্রায় ৩৬৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এখাতে গত তিন মাসে লোকসান হয়েছে প্রায় ৬৩০ কোটি টাকা।
ওয়ার্ল্ডস পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ শাখার সাধারণ সম্পাদক রফিকুল হক বলেন,‘ হরতাল-অবরোধে কর্মাশিয়াল ব্রয়লার মুরগির মাংসে তিনমাসে প্রায় ৯৭৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।’
এনিম্যাল হেলথ কোম্পানিজ এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আহকাব) সাধারণ সম্পাদক ডা. এম নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের পোল্ট্রি খাতে প্রতিমাসে ওষধের বাজার প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। বর্তমানে এ বাজার ৬৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। গত তিন মাসে এখাতে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫৮ কোটি টাকা।
পোল্ট্রিশিল্প নেতারা বলেন,‘ অব্যাহত লোকসান হতে থাকলে এ শিল্প ধ্বংসের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রায় ৭০ লাখ খামারি। বেকার হবে ১ কোটি লোক। প্রভাব পড়বে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। স্বাস্থ্যহীন ও অপুষ্টির শিকার হবে মা ও শিশু।
তারা পোল্ট্রি খাদ্য, ডিম, মুরগি ও ওষুধ বহনকারি গাড়ি হরতাল-অবরোধের আওতামুক্ত রাখতে সরকার ও রাজনৈতিকদলগুলোর প্রতি আহবান জানিয়ে যে সাত দফা দাবি পেশ করেন সেগুলো হলোঃ
১. দেশে অনতিবিলম্বে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।
২. পোল্ট্রি সেক্টরকে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সকল রাজনৈতিক সহিংসতা, হরতাল-অবরোধ থেকে মুক্ত রাখতে হবে।
৩. বর্তমান চলমান সহিংস পরিস্থিতিতে পোল্ট্রির মুরগি, বাচ্চা, ডিম, পোল্ট্রি ফিড এবং ঔষধ সরবরাহকারি ট্রাক, লরি কিংবা কাভার্ড ভ্যানকে বিশেষ নিরাপত্তা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. ডিম ও মাংস উৎপাদনকারি পোল্ট্রি খামারি এবং ব্রিডার্স, ফিড প্রস্তুতকারক, ঔষদ প্রস্তুতকারক ও বিপণনকারিসহ পোল্ট্রিখাতের অপরাপর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিল করতে হবে এবং সুদ সম্পূর্ণরূপে মওকুফ করতে হবে।
৫. বন্ধ হয়ে যাওয়া খামারগুলো পুনরায় চালু করার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।
৬. পোল্ট্রিতে সাম্প্রতিক সময়ে যে ৪ হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছে তা পুষিয়ে দেয়ার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।
৭. এর পাশাপাশি পোল্ট্রি সেক্টরে স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কাছে এ বিষয়ে স্মারকলিপি পেশ করবেন বলে ঘোষণা দেন।
We hope that the condition will be change soon.